
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এবারের মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফলে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক বিষয় যেমন লক্ষ্যনীয় তেমনি অকৃতকার্য হওয়ার হারও উপেক্ষণীয় নয়। এবারই প্রথম ঢাকা শিক্ষাবোর্ড একটা অসাধারণ কাজ করেছে, এসএসসিতে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর কারণ অনুসন্ধান করেছে। যেখানে তারা শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে যাওয়া, অর্থনৈতিক অবস্থাসহ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারার বেশ কিছু কারণ বের করেছে। যাহোক, পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের জন্য পূর্বে যে ধরনের আনুষ্ঠানিকতা আমরা দেখে আসছি, এবার সেখানেও পরিবর্তন এসেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষা উপদেষ্টার নিকট ফল হস্তান্তর না করে স্ব স্ব বোর্ডের মাধ্যমে ফল প্রকাশ হয়েছে।
বছর বছর পাশের হার বৃদ্ধি পাওয়া কিংবা জিপিএ ৫ বাড়ানোর যে প্রতিযোগিতা আগে ছিল, এবার তা দেখা যায়নি। পাবলিক পরীক্ষার ফল সরকারের অর্জন হিসেবে দেখানোর প্রবণতার কারণে আগে শিক্ষকদের উদারভাবে খাতা দেখার একধরনের অলিখিত নির্দেশনা ছিল। এবার সেখানে পেশাদারিত্বের সঙ্গে মূল্যায়নের তাগিদ দেয় শিক্ষা প্রশাসন। যার কারণে পাশের হারে প্রভাব পড়েছে, জিপিএ ৫ এর হারও বাড়েনি। গত বছর যেখানে ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছিল, এবার তা কমে হয়েছে ৬৮.৪৫ শতাংশ। জিপিএ ৫ গত বছর পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার শিক্ষার্থী, এবার ১ লাখ ৩৯ হাজার শিক্ষার্থী। ফল হিসেবে ধারাবাহিক উল্লম্ফন অস্বাভাবিক; হ্রাসবৃদ্ধিই স্বাভাবিক। এবার সেই স্বাভাবিক ফলই হয়তো আমরা দেখছি।
স্বাভাবিক ফলের বার্তাটা কিন্তু অনেক গভীর। সরকারের তরফ থেকে এ চর্চা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও জরুরি। অর্থাৎ ছেলে বা মেয়েকে জিপিএ ৫ পেতেই হবে- এমন মানসিকতা ও প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীর ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। মনে রাখতে হবে, এসএসসি পরীক্ষাই প্রথম পাবলিক পরীক্ষা এবং ১৮ বছরের নিচের শিক্ষার্থীরাই সাধারণত এতে অংশ নেয়। অর্থাৎ শিশু বয়সের সীমারেখার মধ্যেই শিক্ষার্থী এ পরীক্ষাটি মোকাবিলা করে। এ পর্যায়ের পরীক্ষার নানা আনুষ্ঠানিকতা থাকে, যা নবম শ্রেণি থেকেই শুরু হয়। দশম শ্রেণিতে এসে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পূর্বে ‘প্রিটেস্ট’, ‘টেস্ট’, ‘মডেল টেস্ট’ ইত্যাদি পরীক্ষায়ও শিক্ষার্থীকে অবতীর্ণ হতে হয়। এরপর আলাদা কেন্দ্রে বিশেষ পাহারায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হয়। খাতায় বৃত্ত ভরাট করে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করতে হয়। এতসব আনুষ্ঠানিকতায় শিক্ষার্থী অভ্যস্ত হয়ে যায় বটে তারপরও এগুলোও এক ধরনের চাপ। এগুলো শিক্ষার্থী দায়িত্বশীলও করে তোলে। তবে ফলের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের দিক থেকে কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়া উচিত; এমন হওয়া উচিত যে, জিপিএ ৫ পেলে ভালো, কিন্তু কোনো বিষয়ে ছুটে গেলেও অসুবিধা নেই।
ফল যখন অভিভাবকের সামাজিক ‘স্ট্যাটাস’ প্রদর্শনের কারণ হয় এবং শিক্ষার্থী যখন চাপ অনুভব করে তখনই আত্মহত্যার কারণ ঘটে। বিগত বছরগুলোতে যেমন দেখা গেছে, এবারও প্রত্যাশিত ফল করতে না পারায় কয়েকজনের আত্মহত্যার খবর ইতিমধ্যে প্রকাশ হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে এ বিষয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই পরীক্ষার পূর্বে কাউন্সেলিং করা দরকার। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমের মধ্যে যদি এবারও আত্নহননের খবর পাওয়া না যেত নিশ্চয়ই সোনায় সোহাগা হতো।
আমাদের পরীক্ষার ফলের সঙ্গে শিক্ষার মানও অনেকটা জড়িয়ে গেছে। যখনই দেখা যায় জিপিএ ৫ পাওয়া একজন শিক্ষার্থী মৌলিক কিছু বিষয় না পারে, তা স্বাভাবিকভাবেই হতাশার কারণ ঘটে। যা বিগত সময়ে আমরা দেখে এসেছি। সাধারণ ইংরেজি বাক্য বলতে না পারা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় নগন্য শিক্ষার্থীর কৃতকার্য হওয়ার চিত্রও ব্যতিক্রম নয়। সেদিক থেকে শিক্ষা বোর্ডের খাতা দেখার নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে, জিপিএ ৫ পেতে হলে খুব ভালো পড়াশোনা করতে হবে, তবেই তার ইতিবাচক ফল আসতে পারে। আরেকটা হলো, শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষায় পাশের চাইতে শেখার বোধটা জাগ্রত করা দরকার। এতে করে শিক্ষার্থী যেমন আনন্দ নিয়ে পড়ে শিখতে পারবে তেমনি তা ভালো ফলও এনে দিতে পারে। সেটাই আসলে স্বাভাবিক।
এবারের ফলে উদ্বেগের বিষয় অকৃতকার্য হওয়ার হার। ১৯ লাখের মধ্যে ৬ লাখ ফেল করছে কেন? সেই কারণটা বের করতে হবে। বোর্ডগুলোকে দায়িত্ব নিয়ে এটা উচিত। কোনো শিক্ষার্থী যখন নয়–দশ বছর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পেরিয়ে এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষা দেয়, তার নিশ্চয়ই এ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কোনো কারণ থাকার কথা নয়। শিক্ষার্থী সচেষ্ট হলে পাশাপাশি অভিভাবক, প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক তৎপর কোনো শিক্ষার্থীরই ফেল করার অবকাশ নেই। সেজন্যই কারণগুলো আসা দরকার। এতে করে পরবর্তীতে শিক্ষা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। একইসঙ্গে শতভাগ অকৃতকার্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে ত্বড়িত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এবারের এসএসসি ও সমমানের ফল স্বাভাবিক ও ইতিবাচক যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই পথ ধরেই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী করে শতভাগ পাসের লক্ষ্য নিয়ে এগুতে হবে।
সমকাল, ১০ জুলাই ২০২৫: মাধ্যমিকের স্বাভাবিক ফল, অস্বাভাবিক ফেল