Mahfuzur Rahman Manik
ফিলিস্তিন সংকট ও বাইডেনের বিভ্রম
আগস্ট 23, 2023

মূল: সাইমন টিসডাল

ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আমেরিকার প্রভাব যেভাবে হ্রাস পাচ্ছে, তা অস্বাভাবিক। অবস্থার আলোকে মনে হচ্ছে, এ অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যেভাবে আপসে বিদায় নিয়েছে; একই পরিণতি হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। অপ্রতিরোধ্য এক সাম্রাজ্যকে বাদ দেওয়ার পর এ অঞ্চলের দেশগুলো যেন আরেকটি সাম্রাজ্যকে প্রত্যাখ্যান করছে। এ অঞ্চলের শাসক শ্রেণি ও কর্তৃত্ববাদী নেতারা মানুষের এবং কর্মের স্বাধীনতার কথা বললেও তারা নতুন মিত্রের সঙ্গে মিলছেন। এটি বহুমুখী বিশ্বের দিকে ধাবিত হওয়ার ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তনের প্রভাব। বর্তমান বিশ্বে একক পরাশক্তির আধিপত্য আর নেই।

সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের কথা যদি বলি। রাজপরিবারের সদস্যরা সমজাতীয় পরিচয় তৈরি করে এবং আর্থিক প্রভাব, তেল ও খেলাধুলার মাধ্যমে বিদেশে ক্ষমতা প্রদর্শন করে। তাদের কৌশলগত গুরুত্বের অগ্রাধিকারের জন্য তারা পশ্চিমা সুরক্ষা বাতিল করেছে; এখন প্রত্যাখ্যান করছে আমেরিকাকে। এর আগে করেছে ব্রিটেনকে। অন্যদিকে ইসরায়েলে কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় উগ্রবাদীরা ওয়াশিংটনের ইচ্ছার ধার ধারে না। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কথা না শুনে যুদ্ধ করছে; ব্রিটিশদের শেষ সময়ে তারা যে সহিংসতা চালিয়েছিল, সেদিকেই ফিরছে।
এদিকে তুরস্কের রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান আরেক পরাজিত সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। তিনি পশ্চিমাদের লাগিয়ে দিচ্ছেন পূর্বের বিরুদ্ধে; একইভাবে পূর্বকে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন তথা সবার সঙ্গে খেলছেন এরদোয়ান।

জো বাইডেন ২০২১ সাল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চীনের মাধ্যমে আমেরিকার যে সংকট, সে বিষয়ে তিনি সচেতন। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও তিনি সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছেন। পশ্চিম তীর, লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও সুদান তাঁর মনোযোগের বাইরে। মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর চ্যালেঞ্জ হলো ইরানের পরমাণু চুক্তি পুনরুদ্ধার, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে চুক্তি বাতিল করেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি এখনও অপূর্ণ রয়ে গেছে। ১৯৫৬ সালে মিসর আক্রমণের মাধ্যমে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ব্রিটেনের প্রভাব হ্রাস পায়। অপ্রাসঙ্গিক আমেরিকা কি মিসরের সুয়েজ খাল নিয়ে সৃষ্ট সেই সংকটের মতো কোনো পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে? এ প্রশ্নে সম্ভবত বাইডেনের উত্তর– না। এর পরিবর্তে তিনি এ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব পুনরুদ্ধারে উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন দেখছেন। যদিও ইতোমধ্যে দেরি হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে একদিকে যেমন বেইজিং ও মস্কোর প্রভাবের বিরুদ্ধে কাজ করছে, একইভাবে সেখানকার মিত্রদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, যারা নিজেদের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির ঝুঁকিতে ফেলছে। এই মাসে জো বাইডেন লোহিত উপসাগরে আরও ৩০০০ সৈন্য পাঠিয়েছেন। এর কারণ যেমন ইরানকে নিবৃত্ত করা, তেমনি কে বস– সেটা দেখানো। এর মধ্যে রাজনৈতিক হিসাবনিকাশও রয়েছে। বাইডেন আগামী বছর আবার নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন; তিনি এক কঠিন ‘হ্যাটট্রিক’-এর আশা করছেন। পুরস্কারটি কূটনীতির ত্রিমুকুটের সমতুল্য। একটি হলো ইরানের সঙ্গে বোঝাপড়া, অন্যটি সৌদি আরব-ইসরায়েলের মধ্যকার ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি, আরেকটি ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র বিষয়ক। ইরানের বিষয়টি প্রথমে আলোচনা করা যাক। জেলে থাকা আমেরিকানদের মুক্তির বিনিময়ে ইরানের ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের বিষয়ে এ মাসে কাতারে সফল আলোচনা হয়। রাশিয়ার কাছে ইরানি সামরিক ড্রোন বিক্রি বন্ধেও যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্মত হয়। এর শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তির বিনিময়ে তেহরানের অস্ত্র সংক্রান্ত পরমাণু কর্মসূচি বাদ দেওয়া। অর্থনৈতিকভাবে সংকটাপন্ন ইরানের জন্যও এটা ভালো হয়েছে। তবে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিতীয় বিষয়, ইরানের পুরোনো শত্রু সৌদি আরব প্রসঙ্গে আসি। চীনের মধ্যস্থতায় তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে সম্পর্কের সফল পুনরুদ্ধার হয়। এর সঙ্গে মস্কোও যুক্ত। বাইডেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আগ্রহী। এই লক্ষ্যে তিনি একটি নিরাপত্তা চুক্তি করতে চান। এমনকি উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও ইরানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ সৌদি আরবের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচিতে সমর্থন দিতে রাজি তিনি। এ ধরনের চিন্তায় জেরুজালেমে ঘণ্টা বেজে ওঠে। জো বাইডেন বলছেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। সৌদি-ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষা গ্যারান্টি এবং উভয়ের জন্য উন্নত অস্ত্র অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ শক্তি চীনকে পাশ কাটিয়ে এ চুক্তি বাইডেনকে অতিরিক্ত সুবিধা দেবে।

যুক্তরাষ্ট্র কেন সৌদি আরবকে সাহায্য করবে এবং তার সুরক্ষায় কাজ করবে, যেখানে গণতন্ত্র নেই ও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে? ২০১৮ সালের জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডের পর জো বাইডেন সৌদিকে বিশ্বে একঘরে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর উত্তর হলো, সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রাক-নির্বাচনে বড় জয়ের প্রতিনিধিত্ব করবেন। বিশেষ করে যখন তাঁর পরিকল্পনা তৃতীয় ধাপের সঙ্গে যুক্ত অর্থাৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অগ্রগতি। ইসরায়েলে অভ্যন্তরীণভাবে অবরুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তির খুব প্রয়োজন। আর সৌদি আরবও চায় অন্তত কাগজ-কলমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবায়নের পথে অগ্রগতি হোক। নেতানিয়াহুর অতি-ডান জোটের অংশীদাররা যে কোনো প্রকার ছাড়ের বিরোধী। যদিও নেতানিয়াহু বাইডেনের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে তেমন কথা বলছেন না এবং অক্টোবরে তাঁর চীন সফরের কথা। তার পরও বাইডেন মনে করেন, তিনি ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধি, পশ্চিম তীর সংযুক্তিকরণের পরিকল্পনা স্থগিত করার ইসরায়েলি চুক্তিতে জিততে পারবেন। তবে বাইডেনের হ্যাটট্রিকের আশা কিছুটা বিভ্রম বলে মনে হচ্ছে। সেখানে স্থানীয় অগণিত নেতিবাচক কারণ বিদ্যমান। তা ছাড়া সময় এখন তাঁর বিরুদ্ধে। বাকি বিশ্বের মতো স্বার্থান্বেষী আঞ্চলিক নেতারা ভাবছেন, তিনি কতদিন টিকে থাকবেন এবং ট্রাম্প তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন।

সাইমন টিসডাল: গার্ডিয়ানের পররাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক সম্পাদক; গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর

সমকালে প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৩

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।