Mahfuzur Rahman Manik
কাশ্মীরিদের জন্য ন্যায়বিচার
ডিসেম্বর 19, 2022

রিচার্ড ফক

বিশ্বে আত্মপরিচয় রক্ষায় যারা সংগ্রাম করছে, কাশ্মীরি জনগোষ্ঠী তার অন্যতম। অথচ কাশ্মীরিদের কথা বিশ্বের অধিকাংশ দেশই ভুলে গেছে। তারা ৭৫ বছর ধরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন সহ্য করে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার একতরফাভাবে এবং স্বৈরাচারী কায়দায় ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে। ওই ধারা কাশ্মীরকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত এলাকার মর্যাদা দিয়েছিল। সেখানে নিজেদের সুরক্ষায় কাশ্মীরিদের কিছুটা যে অধিকার ছিল তা কেড়ে নেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালটি দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। কারণ ওই বছরই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। বিভাজনের ফলে রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। একদিকে প্রতিষ্ঠা হয় মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান; অন্যদিকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের জন্ম হয়। সে সময় ভারতে ৫৬০টি বিশেষ রাজ্য ছিল, যেগুলোকে বলা হয় প্রিন্সলি স্টেটস। কাশ্মীরও ছিল তেমন একটি রাজ্য। এই কাশ্মীরের জনগোষ্ঠীর ৭৭ শতাংশই ছিল মুসলমান। ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজন চুক্তি অনুসারে বলা হয়, তারা চাইলে দুই দেশের যে কোনো একটির সঙ্গে থাকতে পারবে।

ধারণা করা হয়েছিল, হিন্দু জনগোষ্ঠী ভারতকে এবং মুসলিম জনগোষ্ঠী পাকিস্তানকে সমর্থন করবে। কিন্তু সেখানে ভারতের মাতব্বরির কারণে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। এমনকি কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধও সংঘটিত হয়। সাময়িকভাবে তখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে লাইন অব কন্ট্রোল সীমান্তরেখা টানা হয়। এরপরও উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয় এবং আজ পর্যন্ত বিভক্ত কাশ্মীরের মধ্যে কোনো আন্তর্জাতিক বিভেদরেখা নেই। পাকিস্তানের নেতারা সবসময় বিশ্বাস করতেন, ভারতের আচরণ দখলদারিত্বের মতো এবং অগ্রহণযোগ্য।

ভারতের বিশ্বাসঘাতকতায় কাশ্মীরিরা ভারত কিংবা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল নেতৃত্ব এ ব্যাপারে কঠোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- কাশ্মীরিরা যেভাবে চায় সেভাবে তাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করা হবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত গণভোটের মাধ্যমে এবং সেখানে শিগগিরই তাদের অধিকার ফিরে পাবে। উভয় দেশই এ ব্যাপারে একমত হয়েছিল, তারা বিষয়টি জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করবে; যাতে কাশ্মীরিরা তাদের অধিকার ফিরে পায়। কিন্তু ধীরে ধীরে ভারত এমন ব্যবস্থা নেয়, যাতে আন্তর্জাতিকভাবে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে না পারে। দৃশ্যত এটা স্পষ্ট, ভারত প্রাথমিকভাবে কৌশলগত ও জাতীয় স্বার্থে কাশ্মীরের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল, যাতে কাশ্মীর সীমান্তে থাকা চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পারে এবং কাশ্মীরকে ভারতের বাফার স্টেট বানাতে পারে। আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তান যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ভারতের ব্যর্থতার বিষয়টি মোকাবিলা করেছে। শেষ পর্যন্ত ভারত দখলকৃত ও পাকিস্তান দখলকৃত ছোট অংশ- দুই ভাগে কাশ্মীর বিভক্ত হয়।

ভারতের একতরফা নীতির কারণে দুই দেশের সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়। সে কারণেই পরবর্তী সময়ে ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশ পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হয়। একই সঙ্গে কাশ্মীরি জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। গণহত্যা, নির্যাতন, বলপূর্বক অপহরণ, যৌন সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, শক্তি খাটানো প্রভৃতি মানবতাবিরোধী অপরাধ তাদের ওপর সংঘটিত করা হয়। তাদের বঞ্চনা ফিলিস্তিন ও পশ্চিম সাহারার সঙ্গে তুলনা করা যায়।


কাশ্মীরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অস্বীকার করা হলেও তাদের স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ভারতের ৭৫ বছরের দখলদারিত্ব সত্ত্বেও কাশ্মীরি জনগণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু অধিকার পায়। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা রদ করার মাধ্যমে ওই কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন। তাঁরা কাশ্মীরকে সরাসরি ভারতের শাসনে নেন, যাতে হিন্দুদের আধিপত্য বজায় রাখতে পারেন। কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে দিনে দিনে নিপীড়নের হার বাড়লেও পশ্চিমা বিশ্ব চুপ করে আছে। ভারতীয়দের ব্যবহারকে কাশ্মীরিরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ভারতের সামরিক বাহিনীতে সাত লাখেরও বেশি সৈন্য রয়েছে, যারা কাশ্মীরিদের ভীতির মধ্যে রাখে।

কাশ্মীরের বিষয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক লঘু প্রতিক্রিয়া তাদের তেমন উপকারে আসে না। কারণ অনেক দেশই সেখানে ভূরাজনৈতিক খেলা খেলে। আমরা দেখেছি কিউবা কিংবা ভেনিজুয়েলায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক মায়াকান্না করে। অথচ তারা মিসর কিংবা সৌদি আরবকে যেন 'ফ্রি পাস' দিয়ে দিচ্ছে। ইসরায়েল মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও সেখানে জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীরব। ইসরায়েলের মতো ভারতও পশ্চিমাদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, যেখানে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন দেশটি কাশ্মীরে অন্যায় আচরণ করার পরও ছাড় পাচ্ছে। এটি দুর্ভাগ্য, মানবাধিকার রক্ষার ধ্বজাধারীদের এ ক্ষেত্রে কিছু করণীয় থাকলেও তারা নীরব।

বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে ভারত একটি বৃহৎ দেশ। পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ। একেবারে সুবিধাজনক সময়েও তাকে চ্যালেঞ্জ করা যে কোনো জনগোষ্ঠীর পক্ষে কঠিন। বহু বড় দেশ আছে, যাদের এ রকম 'বন্দি জাতি' আছে এবং যারা ওই বন্দি জাতিগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নে একাট্টা হয়ে পড়ে। সময় অনেক গড়িয়ে গেলেও জাতিসংঘ কাশ্মীরিদের নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারসংবলিত গণভোটটি করতে পারে; যদিও ভারতের বিদ্যমান কাশ্মীর নীতির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এ ধরনের শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রায় অসম্ভব।

এত কিছু সত্ত্বেও পরিস্থিতি একেবারে হতাশাজনক- এমনটা বলা যায় না। কাশ্মীরিদের অধিকার আইনে যেমন স্বীকৃত, তেমনি নৈতিকতার দিক থেকেও গ্রহণযোগ্য। ভারতীয় শাসকরা সেখানে যা করছে, তাকে বর্ণবাদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তারা সেখানে জনগণকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করছে। তাদের ওপর আধিপত্য চালাচ্ছে। শোষণ চালাচ্ছে। মনে রাখতে হবে ১৯৪৫ সাল থেকে উপনিবেশবিরোধী যেসব সংগ্রাম জয়ী হয়েছে, তারা দুর্বল সেনাবাহিনী নিয়ে তা করেছে। কাশ্মীরিদের উচিত সেই ধরনের যুদ্ধের আগে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং এ জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারা মহাত্মা গান্ধীর কৌশল প্রয়োগ করতে পারে। ভিয়েতনাম তাদের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের পক্ষে বিশ্বব্যাপী সংহতি তৈরির জন্য যে ধরনের কৌশল নিয়েছিল, কাশ্মীরিরা তাও করতে পারে।

রিচার্ড ফক: প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনবিষয়ক ইমেরিটাস অধ্যাপক; কাউন্টার পাঞ্চ থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর

সমকালে প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।