ফাবিয়ান কোহ
ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক
মালয়েশিয়ার জাতীয় নির্বাচনে গত শনিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের পরাজয় অনেকের জন্যই বেদনাদায়ক। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি যেভাবে মালয়েশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেন; যেভাবে তাঁকে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার বলা হয়; তাঁর পরাজয় সে সুনামে রেখাপাত করেছে। আমরা জানি, ৯৭ বছর বয়সী মাহাথির কৃষির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল অর্থনীতিকে আধুনিক শিল্পায়ন ও উৎপাদনমুখী অর্থনীতিতে রূপান্তর করেন। একই সঙ্গে তাঁর শাসনক্ষমতায় অনেকে তাঁকে বিভেদরেখা সৃষ্টিকারী হিসেবেও চিহ্নিত করেন। তিনি যেভাবে বর্ণবাদী নীতি গ্রহণ করে ক্ষমতা সুসংহত করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় দুর্নীতি আজ মালয়েশিয়াকে গ্রাস করেছে।
মালয়েশিয়ার ১৫তম সাধারণ নির্বাচনে ড. মাহাথির মোহাম্মদ গেরাকান তানাহ এয়ার বা জিটিএ জোটকে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু তাঁর জোট হেরে যায়। এমনকি তিনি তাঁর আসন লঙ্কাউইতেও জিততে পারেননি। বলা বাহুল্য, এটি ৫৩ বছরের মধ্যে তাঁর প্রথম পরাজয়। ১৯৬৯ সালের নির্বাচনে তিনি প্রথম পরাজিত হন। এমনকি তিনি এবার তাঁর জামানত পর্যন্ত হারিয়েছেন। তাঁর ওই আসনে জিতেছেন মোহাম্মদ সুহাইমি আবদুল্লাহ। তিনি মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের নেতৃত্বাধীন পেরিকাতান জোট থেকে নির্বাচন করেন।
মালয়েশিয়ায় মাহাথিরের কীর্তির প্রমাণ রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। রাজধানী কুয়ালালামপুরের সবখানেই তাঁর নাম যেন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। এক সময় বিশ্বের উচ্চতম টুইন টাওয়ার হিসেবে পরিচিত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ অর্থনৈতিক জোন মাল্টিমিটিয়া সুপার করিডোর এবং এ রকম স্থাপনায় তাঁর নাম লিখিত রয়েছে। মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়াকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তর করতে ১৯৯৬ সালে মাল্টিমিটিয়া সুপার করিডোরের ঘোষণা দেন। তাঁর কাজের বিপরীতে শনিবারের নির্বাচনে যে ফল আমরা দেখেছি, তা সত্যিই হতাশাজনক। মালয়েশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা মাহাথির মোহাম্মদের জন্য এ বাস্তবতা মেনে নেওয়া কঠিন। কেদা রাজ্যের লঙ্কাউইয়ের জন্যও এটা কম সংকটজনক নয়।
প্রথমবার যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হন তখন রাজধানী কুয়ালালামপুরের পরে উন্নয়নের দিক থেকে কেদাও অগ্রাধিকার পায়। কেদায় বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তখন ব্যাপক খরচ করা হয়। সে সময় লঙ্কাউইকে আন্তর্জাতিক মানে গড়ে তোলার সব উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেছিলেন। বস্তুত তাঁর কাজের কারণেই তিনি ওই আসনটিতে জিতে আসছিলেন।
মাহাথির মোহাম্মদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে আইএসইএএস-ইউসুফ ইশাত ইনস্টিটিউটের মালয়েশিয়া প্রোগ্রামের ভিজিটিং ফেলো ড. সেরিনা আবদুল রহমান বলেন, আমি তাঁকে সব সময় এমন ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণ করি, যিনি বলেছিলেন, যদি তুমি কৃষি ও মৎস্য থেকে শিল্পায়নে উত্তরণ ঘটাতে না পার, তবে তুমি অলস। তিনি শিল্পকারখানা গড়ার ব্যাপারে বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি মালয়েশিয়ায় নতুন অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন। যদিও তাঁর সামাজিক অর্থনৈতিক পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন বর্ণভিত্তিক নীতিতে। সে সময়ে যে ভূমিপুত্র নীতি গ্রহণ করে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায়ন করেছিলেন, সেটিকে অনেকে ভিন্ন দিক থেকে ব্যাখ্যা করে থাকে। তবে মালয়েশিয়ার জন্য বিশেষ করে ওই সময়ের জন্য এই নীতি ছিল যথার্থ। গোটা মালয়েশিয়ার উন্নয়নে তিনি বেশ কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই, বিশেষত প্রসঙ্গের বাইরে বিষয়টিকে বিবেচনা করায় তিনি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন। সম্ভবত এসব সমালোচনা তিনি নিজেও প্রত্যাশা করেননি।
মাহাথির প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ের ভূমিপুত্র নীতির বিরুদ্ধে যাঁরা অভিযোগ করেন যে, তাঁর ওই নীতি মানুষের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষ প্রকট করেছে; তাঁদের অনেকেই তাঁর পরাজয়ে খুশি। তাঁরা বলছেন, ওই নীতির কারণে মালয়েশিয়া চীনা সমাজে পরিণত হবে। আবার চীনা কমিউনিটির মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা মাহাথিরের সময় সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। বস্তুত মাহাথির মোহাম্মদ মালয়া নন এমন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছেন। সেদিক থেকে চীনা অনেকেই বলবেন, তাঁর সে যুগের অবসানে তাঁরা খুশি। বলা বাহুল্য, মাহাথির ক্ষমতাকে ইউনাইটেড মালায়াস ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন- ইউএমএনওর মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছিলেন।
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বর্তমানে ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত। কারণ তিনি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। ইউএমএনওর বর্তমান প্রধান আহমদ জাহিদ হামিদিও বর্তমানে দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত। ফলে মাহাথির যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা একদিকে যেমন তাঁর গর্বের বিষয়, অন্যদিকে তাঁর দুর্বলতাও। ২০২০ সালে মালয়েশিয়ায় যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়; যেখানে অল্প সময়ে পাকাতন হারাপন সরকারের পতন হয়; এর দায়ও মাহাথির এড়াতে পারেন না।
যা হোক, এ নির্বাচনে মাহাথির মোহাম্মদের পরাজয় মানে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে একটি যুগের সমাপ্তি। একই সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে রাজনীতি করা ব্যক্তিত্ব টেংকু রাজালেই হামজা, যিনি ১৯৭৪ সাল থেকে সংসদ সদস্য, তিনিও এ নির্বাচনে হেরেছেন। এই দু'জন সত্তরের দশক থেকে প্রজন্মকে প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। এবার জনগণ মাহাথিরকে যেভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, সেটা কলঙ্কজনকই বটে। এটা একই সঙ্গে মানুষের পক্ষ থেকে এই বার্তাও যায়- ৯৭ বছর মানে এখন বিশ্রামের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। একই সঙ্গে তাঁর পরাজয়ের মানে হলো, ভোটাররা অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায়। অন্যরা যদিও মালয়েশিয়ান ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাট অ্যালায়েন্স- এমইউডিএর ২৯ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ সাদিকের বয়সী নন; এর পরও তাঁরা মাহাথিরের তুলনায় যথেষ্ট তরুণ। অনেক ভোটারের ভাষ্য, তিনি এখন বয়স্ক। সে জন্য তিনি তাঁর নাতির সঙ্গে সময় কাটাতে চান। সুতরাং বয়সের বিষয়টিই আসলে মাহাথিরের ক্ষেত্রে নিয়ামক।
করোনা মহামারির কারণে লঙ্কাউইর পর্যটনে যে করুণ প্রভাব পড়েছিল, সেখান থেকে উদ্ধারে লঙ্কাউইর ভোটাররা হয়তো এমন একজন প্রার্থীকে জয়ী করে, যিনি সেখানে সত্যিকার অর্থেই উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন। তা ছাড়া গেরাকান তানাহ এয়ার-জিটিএ জোট দেশজুড়েই খুব ভালো কাজ করতে পারেনি। জিটিএ জোটের অন্য প্রার্থীরাও ভালো করতে পারেননি। এমনকি মাহাথির মোহাম্মদের ছেলে মুখরিজ মাহাথিরও জয়লাভ করতে পারেননি। এর মানে, এ কি শুধু মাহাথির মোহাম্মদের নিজের, নাকি তাঁর পরিবারেরও রাজনীতি থেকে অবসরের ইঙ্গিত? সময়ই তা বলে দেবে।
ফাবিয়ান কোহ: সিঙ্গাপুরভিত্তিক চ্যানেল নিউজ (সিএনএ) এশিয়ার সাংবাদিক; সিএনএর ওয়েবসাইট থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত