এবার বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য 'সামষ্টিক জীবনে নদীপথের গুরুত্ব'। নদীমাতৃক দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের জীবনে নদীর গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না। নদীপথ নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাত্রার আলোকেই দেখার অবকাশ রয়েছে।
আমরা জানি, নদীর সঙ্গে সভ্যতার সম্পর্ক। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ হলো, নদীপথের সহজ যোগাযোগ। নদীর মধ্যে যে সর্বজনীনতা রয়েছে, সেটাই নৌপথের ক্ষেত্রে ঘটেছে। সামাজিক জীবনের কথা যদি আমরা চিন্তা করি, এখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের যে সম্মিলন, নৌপথে সেটাই আমরা দেখি।
প্রাচীনকালের অনেক শহরের বিকাশও ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করে। আমাদের সোনারগাঁ তো রয়েছেই। তা ছাড়া স্বাধীন সুলতানি আমলের সাতগাঁও, লখনৌতি, বঙ্গ, জান্নাতাবাদ, মাহমুদাবাদ কিংবা বারবকাবাদের মতো নগরগুলোর বিকাশ নদীতীরে। এর অন্যতম কারণ, তখন যাতায়াতের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বাহন ছিল নৌকা। নৌকা আমাদের বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য অনুষঙ্গ।
এখনও নৌকা চলে কিন্তু নদীপথ আর আগের মতো নেই। এখন আমাদের হিসাব করতে হয়, বছরে কত নৌপথ কমল। তারপরও সামষ্টিক জীবনে নদীপথ এখনও যে অবদান রেখে চলেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই জানেন, নদীপথে চলাচলের সুবিধা বহুমাত্রিক। এখানে সড়ক কিংবা বিমানপথের তুলনায় খরচ অনেক কম। নদীপথে ভ্রমণ আরামদায়ক। জ্বালানির হিসাবেও এ পথ অনেক সাশ্রয়ী। নৌপথ পরিবেশবান্ধব এবং তুলনামূলক নিরাপদও। যাত্রী হিসেবে তো বটেই, মালপত্র পারাপারেও নদীপথ সহজলভ্য। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে কম খরচে এবং সহজে ভারী ও ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যও বহন করা যায়। এতসব সুবিধা থাকার পরও নদীপথ কমছে। কারণ নদীপথের ভাগ্য স্বাভাবিকভাবেই নদীর সঙ্গে যুক্ত। আমরা দেখছি দেশের ছোট-বড় প্রায় সব নদীই দখল-দূষণের থাবায় বিপর্যস্ত। সারাদেশে নদী দখলদারের পরিসংখ্যানটি ভয়াবহ, গত বছর তেষট্টি হাজারের অধিক দখলদারের পরিসংখ্যান এসেছে নদী কমিশনের হিসাবে, যা এর আগের বছরের তুলনায় অন্তত ছয় হাজার বেশি। প্রতিটি বিভাগেই পেশিশক্তি ও প্রভাব বিস্তার করে অনেকে নদীপাড়ে বা মধ্যে বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ করেছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, কর্তৃপক্ষ ওইসব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারেনি।
নদীপথ কতটা কমেছে? ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার বা আইইউসিএনের তথ্য বলছে, ১৯৬০ সালে দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার। তার মধ্যে এখন ৬ হাজার কিলোমিটারও নেই। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অবশ্য ভিন্ন। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, দেশে নদনদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে এখন ৬ হাজার কিলোমিটারে নৌযান চলাচল করতে পারে। শুস্ক মৌসুমে এটি আরও কমে যায়। চার হাজারের কিছু বেশি কিলোমিটার এখন নৌপথ। নৌপথ কমলেও সরকার এ পথের সুরক্ষায় কিংবা নৌপথ বাঁচাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। নৌপথ যে অবহেলিত, সেটা সরকারি বরাদ্দেই স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে সড়ক, রেল, আকাশ ও নৌপরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পায় নৌপথ। সাম্প্রতিক অর্থবছরের একটি বাজেট বিশ্নেষণ করে আমরা দেখেছি, এ খাতে ব্যয়ের মোট বরাদ্দের ৬২ শতাংশ রয়েছে সড়কের জন্য; রেলের জন্য বরাদ্দ ২৩ শতাংশ, আকাশপথের জন্য প্রায় ৭ শতাংশ। সবচেয়ে অবহেলিত নৌপরিবহন খাতের জন্য বরাদ্দ ৬ শতাংশের কিছু বেশি।
নৌপথ কমার পেছনে আরেকটি দিক হলো, নিয়মিত নদী ড্রেজিং না করা। যে কারণে পলি পড়ে নৌপথ ভরাট হয়ে যায়। সঠিক পরিকল্পনা করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ড্রেজিং না করলেও অবশ্য তাতে সুফল মিলবে না। কিন্তু এটি এখন জরুরি সেটা বুঝতে হবে, কারণ আমাদের জনসংখ্যার সঙ্গে পরিবহনের চাহিদাও বাড়ছে। এ জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্প নৌপথ। এ পথে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই। নৌপথ গুরুত্ব পেলে সড়কপথের ওপর চাপ কমবে। কিন্তু যেখানে আমাদের নদীই সুরক্ষিত নয়, সেখানে নৌপথ নিয়ে ভাবনা তো দূর অস্ত।
অথচ নদী সুরক্ষায় আমাদের আইন আছে, আদালতের নির্দেশনা রয়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, সরকারের অঙ্গীকার রয়েছে। তা সত্ত্বেও নদী রক্ষায় সরকারের সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠান নদী রক্ষা কমিশনের ভূমিকা আমরা দেখছি না। দেশের উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে নিশ্চয়ই কিন্তু উন্নয়নের নামে নদীর জমি দখল কিংবা পরিবেশ ধ্বংস প্রত্যাশিত নয়। নদী রক্ষা যদি সত্যিই সরকারের অগ্রাধিকারে থাকে, তার প্রতিফলন আমরা দেখতে চাইব। এভাবে দখল-দূষণ চলতে থাকলে, প্রশাসন অসহযোগিতা করলে এবং নদী পুনঃপুনঃ দখল করলে নদী সুরক্ষা কেবল স্বপ্নেই থাকবে, একই সঙ্গে নদী রক্ষা মহাপরিকল্পনা হবে সুদূরপরাহত। আমাদের বাঁচার জন্যই নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। নদী দখলদার যে-ই হোক, তাকে উচ্ছেদ করতে হবে। উচ্ছেদের পর নদীর জমি রক্ষায়ও ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
নদীপথে যারা যাতায়াত করে, এর বড় অংশই লঞ্চে চড়ে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৩৪ জেলার মানুষ লঞ্চে চলাচল করে। এর বাইরে পারাপারে ফেরি ব্যবহার করে অনেকে। তা ছাড়া দেশের সর্বত্র রয়েছে নৌকা। গ্রাম এলাকায় অনেকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ভেলা। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা এক সামষ্টিকতার পরিচয় পাই। যারা লঞ্চে যাতায়াত করে তারা জানে, সেখানে অনেকটা সামাজিক পরিবেশ। লঞ্চে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের যেন সম্মিলন ঘটে। এখানে পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ট্ক্রিয়ার সুযোগ হয়।
নৌপথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেদিকটি আমাদের সামষ্টিকতায় অবদান রেখেছে, সেটি হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। নৌপথের সুবিধা কাজে লাগিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ব্যবসা করে আসছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাজারে ব্যবসায়ীরা পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন নৌপথ ব্যবহার করে আসছেন, তেমনি এ পথের যানবাহন যেমন লঞ্চ-স্টিমার বা নৌকাও অনেকের আয়ের পথ। দেশ এবং দেশের বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ ও পণ্য আনা-নেওয়ায় নৌপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বর্ষা মৌসুমে নৌপথ সম্প্রসারিত হয়। দেশের শুকিয়ে যাওয়া অনেক নদীতে পানি আসে। তখন মানুষ নদীগুলোকে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করে। নদীকে কেন্দ্র করে আরও নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডও গড়ে ওঠে। নদীর পাড়ে অনেক স্থানে মেলা জমে। সেখানে মানুষের মধ্যে সদ্ভাব হয়।
নদী দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে নৌপথ সামনে এলেও তার মধ্যেই নদী সুরক্ষার বিষয়টি নিহিত। অমাদের রাজধানী ঢাকা গড়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গার তীরে। বস্তুত ঢাকার চারপাশেই রয়েছে নদী। ঢাকার চারপাশকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার নৌপথ গড়ে উঠলেও নানা সংকটে সেগুলো নিয়মিত নয়। নৌপথের সামষ্টিক গুরুত্ব আরও বাড়বে যদি আমরা নদীগুলোকে উদ্ধার করতে পারি। এ জন্য প্রথম কাজটি হওয়া উচিত নদী দখলমুক্তকরণ। নদী থেকে বর্জ্য উত্তোলন বুড়িঙ্গার মতো নদীগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ। নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে এটি আবশ্যক। শাখা-প্রশাখা মিলে দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে ৫০-এর অধিক। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেভাবে নদী সুরক্ষা করা হয়, সেটি আমাদের জরুরি। লন্ডনের কথা বললে সৌন্দর্যের আধার টেমস নদী অনেকের চোখে ভাসবে। কানাডার টরন্টোর চোখ জুড়ানো লেক অন্টারিও আর আমেরিকার শিকাগো শহরে রয়েছে সৌন্দর্যমণ্ডিত হার্ডসন নদী। নদীগুলোকে রক্ষা করে পরিকল্পিতভাবে এর নৌপথ ব্যবহার করলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অনেক দিক থেকে সমৃদ্ধি নিয়ে আসত।
নদীপথে নৌকায় চড়ে নদীর দুই ধারের যে সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়, উঁচু আকাশ, দুই ধারের প্রাকৃতিক জমিন আর হিমেল বাতাস যে স্নিগ্ধতা দেয়, সে অনুভূতি অন্য কোথাও কি মিলবে? নদীপথ এখনও আছে কিন্তু এর বিকল্প হিসেবে সড়কপথ আমরা তৈরি করে নিয়েছি এবং সেখানেই গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু যে নদী সভ্যতা গড়েছে, শহর গড়েছে, মানুষের বন্ধনে সহায়তা করেছে, সামষ্টিক যোগাযোগে ভূমিকা রাখছে, সে পথটি কেন অবহেলিত থাকবে? নদীমাতৃক দেশের জন্য এটি বড্ড বেমানান।