Mahfuzur Rahman Manik
ভোটের আগে জাতীয় পার্টির 'যথারীতি' ভাঙন?
সেপ্টেম্বর 16, 2022

জাতীয় নির্বাচনের মৌসুমের সঙ্গে জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের যেন অলিখিত সম্পর্ক রয়েছে। নব্বই দশক থেকে প্রায় প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের আগে দলটি ভেঙেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও দলটিতে যে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, তাতে যেন আগের অঘটনেরই প্রতিধ্বনি। বৃহস্পতিবার সমকালের প্রথম পাতার খবর- 'বিরোধী দল হতে গিয়ে চাপে জাতীয় পার্টি'। প্রতিবেদন অনুসারে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের যখন সরকার ও নির্বাচন ব্যবস্থার সমালোচনা করছেন; তখনই তৎপর হয়ে উঠেছেন দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। দেবর-ভাবির বিরোধ পুরোনো হলেও সাম্প্রতিক তৎপরতা বিশেষ করে সরকার সমর্থক বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ যেভাবে নেতৃত্ব থেকে জি এম কাদেরকে 'সরাতে' হঠাৎ সম্মেলন ডাকেন, সেটাই পুরাতন প্রবণতার নতুন মাত্রার দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের হাতে মনে হলেও; দলের প্রভাবশালী নেতা সবাই তাঁর পক্ষে মনে হলেও; সর্বশেষ দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার 'বিদ্রোহ' এবং দলীয় সব পদ থেকে তাঁকে অব্যাহতি প্রদানের পর মনে হচ্ছে, দেখার বাকি রয়েছে অনেক কিছু।
অথচ এ মাসের প্রথমদিকেই জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নির্বাচন করতে জাতীয় পার্টি সংসদীয় দলের পক্ষে স্পিকারকে যে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ রাঙ্গাই তৎপর ছিলেন। ওই চিঠির কার্যকারিতা অবশ্য এখনও মেলেনি। আর খোদ রাঙাই আগের অবস্থান বদল করে উল্টো চিঠির শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ফলে অনেকেই মনে করছেন, সরকারের সমর্থন রওশন এরশাদের দিকেই। রাঙ্গার উল্টোগীতও নিছক 'অভ্যন্তরীণ' বিষয় নয়। তাহলে কি জাতীয় পার্টিতে আরেকটি ভাঙন আসন্ন?
জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাত ধরে। ১৯৮৬ সালে তিনি যখন দলটি প্রতিষ্ঠা করেন, তখন চলছিল সামরিক শাসন। সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি ক্ষমতা দখল করে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। মোটাদাগে জাতীয় পার্টিতে চারটি ধারা স্পষ্ট। মূল দল অর্থাৎ এইচএম এরশাদ যেখানে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, সেখানে আছেন তাঁর ভাই জি এম কাদের ও তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ। এর বাইরে তিনটি অংশ- জেপির নেতৃত্বে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু; বিজেপির নেতৃত্বে আন্দালিব রহমান পার্থ; জাতীয় পার্টির (জাফর) নেতৃত্বে মোস্তফা জামাল হায়দার।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি। ওই সময় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন জাতীয় পার্টির নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। পরে এরশাদ যখন বিএনপি-জামায়াত জোটে যোগ দেন; আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তাতে যোগ দেননি। তিনি দল ভেঙে গঠন করেন জাতীয় পার্টি-জেপি। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে আগে এইচএম এরশাদ বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যান। সে সময় জাতীয় পার্টির দুই প্রভাবশালী নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জু এবং এমএ মতিন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি গঠন করে ওই জোটে থেকে যান। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট করেন এরশাদ। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদের নাটকীয় অবস্থান আমরা দেখেছি। একবার ঘোষণা দেন- ভোটে যাবেন। আবার বলেন- ভোটে যাবেন না। এরশাদের অবস্থান বদলের খেলায় ক্ষুব্ধ হয়ে দল থেকে বেরিয়ে যান কাজী জাফর আহমদ। তিনি ব্রাকেটবন্দি জাতীয় পার্টি গঠন করেন।
জাতীয় পার্টির অবস্থান ও পাল্টা অবস্থানের খেলা সম্ভবত এখনও শেষ হয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে জাতীয় পার্টির একাংশ তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়ে ভোটে যায়। পরে দলে বিভক্তি তৈরি না হলেও ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর দলটিতে দেবর-ভাবির বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখন যে সংকট আমরা দেখছি, তাতে ক্ষমতাসীন দল ২০১৪ সালের মতো ফের রওশন এরশাদের ওপরেই ভরসা করতে চাইবে। আর এর 'অভিঘাত' হিসেবে দলটি যদি ফের ভাঙনের মুখে পড়ে, অবাক হওয়া কঠিন।
বস্তুত জাতীয় পার্টির ভাঙনের তিনটি কারণ স্পষ্ট। প্রথমত, দলটি বিশেষ কোনো আদর্শ নিয়ে গড়ে ওঠেনি। যে কারণে সুবিধাবাদীরা নিজের স্বার্থে দলটিতে যোগ দিয়েছে। আদর্শ না থাকায় ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নেতারা দল ভাঙতেও কুণ্ঠা বোধ করেননি। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীনরা বরাবরই জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি- উভয় দলই জাতীয় পার্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করতে চেয়েছে। আর এ সুযোগ তারা পেয়েছে এইচএম এরশাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা থাকায়। তৃতীয় কারণ সেটিই। এরশাদ নিজেও মামলার কারণে চাপে থাকার বিষয়টি বলে গেছেন। এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থায় যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল; সে দল মামলাটিকে তাঁর বিরুদ্ধে এক ধরনের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। এরশাদ একে একে ৪২টি মামলা থেকে খালাস পেলেও শুধু মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যা মামলায় তিনি আটকে ছিলেন।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টির অনিশ্চিত ভাঙাগড়ায় যে বিষয়টি সবসময় নিশ্চিত থেকেছে, তা হলো- যখনই দলটি ভাঙনের মুখে পড়েছে বা ভেঙেছে, তখনই এর ভোট কমতে শুরু করেছে। এরশাদের পতনের পর বিশেষ করে ১৯৯১ ও '৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি যত ভোট পেয়েছিল; পরবর্তী সময়ে তা ক্রমাগত কমেছে। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে দলটির যে 'ভোট ব্যাংক' ছিল; তাও আর অক্ষুণ্ণ নেই। আরেক দফা ভাঙন মানে আরেক দফা ভোটক্ষয়।
এটাও ঠিক, ভোট কমলেও জাতীয় পার্টি একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের বাইরে যারা রয়েছে, তাদের মধ্যে জাতীয় পার্টির অবস্থান এখনও অটুট। উপযুক্ত কর্মসূচির মাধ্যমে দলটির এখনও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে। নেতারা যদি বিভাজন ভুলে এক কাতারে দাঁড়াতে পারেন; নিজের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেন; জাতীয় পার্টি নিঃসন্দেহে ভালো করবে। আর কথায় কথায় বহিস্কার, পাল্টা বহিস্কার; দলের চেয়ে ব্যক্তির সুবিধাকে প্রাধান্য দিলে ক্ষয়িষুষ্ণ ধারাই জোরদার হতে থাকবে। আর কিছু না হোক; আগামী নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির আরেক দফা ভাঙন অনিবার্য হয়ে উঠবে।

সমকালে প্রকাশিত ১৬ সেপ্টম্বর ২০২২

ট্যাগঃ , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।