Mahfuzur Rahman Manik
গার্ডার ধসে মৃত্যু এবং কর্তৃপক্ষের বহাল তবিয়ত
আগস্ট 21, 2022
Girder-falls-on-private car

সোমবার জাতীয় শোক দিবসে (১৫ আগস্ট ২০২২) রাজধানীবাসীর জন্য আরও বেদনা হিসেবে যুক্ত হয়েছে দুটি দুর্ঘটনা; দুপুর ১২টায় চকবাজারের একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডের বিভীষিকায় ছয় হোটেল কর্মীর মৃত্যুর অঘটন হজম করতে না করতেই আসে উত্তরায় প্রাইভেটকারের ওপর গার্ডার ধসে পিষ্ট হয়ে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর। চকবাজারের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডজনিত এ মৃত্যুর বেদনা ছাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গার্ডার ধসে মত্যুর অঘটন স্বাভাবিকভাবেই বেশি আলোচনায় আসে। রাজধানীর একটি ব্যস্ততম সড়কে কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া ছাড়াই কীভাবে এমন উন্নয়নযজ্ঞ চলছিল? অথচ নির্মাণকাজ শুরুর পর সোমবারের অঘটনের আগে একই প্রকল্পে উড়ালপথ তৈরির গার্ডার ধসে অন্তত তিনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর পরও কর্তৃপক্ষ যেভাবে উদাসীন ছিল তাতে বড় দুর্ঘটনা না ঘটাই বরং অস্বাভাবিক।

বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কে প্রায় এক দশক ধরে চলছিল বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের কাজ। এ ধরনের প্রকল্পের কাজের ক্ষেত্রে সাধারণত বলা হয়, 'সেফটি ফার্স্ট' বা নিরাপত্তার প্রথম। এ নিরাপত্তা যেমন কর্মরত শ্রমিকদের জন্য জরুরি, তেমনি পথচারীসহ প্রকল্প এলাকাধীন সব মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই উন্মুক্ত স্থানের প্রকল্পগুলো সাধারণ খুব দ্রুত এবং বিশেষত রাতে বাস্তবায়ন করা হয়। অথচ বিআরটি প্রকল্পটিতে সেদিক থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা গেল। অন্যান্য নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা নাই বললেও, যখন একটি ক্রেন দিয়ে ৪০-৪৫ টনের একটি গার্ডার ওঠানো হয় তখন তো অন্তত সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা রাস্তায় চলাচলকারী যানবহন কিংবা যাত্রীদের আটকাবে। তাও নেওয়া হলো না কেন? কতটা দায়িত্বহীন হলে এমনটা ঘটতে পারে? সেজন্যই সমকালের প্রতিবেদনে এসেছে, ঘটনার পর ক্রেন অপারেটরসহ দায়িত্বরতরা পালিয়ে যায়।

উত্তরার অঘটনের কয়েকটি ছবি বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। একটি ছবিতে স্পষ্ট, ওপর থেকে পড়া গার্ডারের চাপায় প্রাইভেটকারের অধিকাংশ অংশ পিষ্ট হয়ে আছে। অবশ্য গাড়িটির সামনের অংশ আর চালকের পাশের আসনটি অক্ষত রয়েছে। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, যে ক্রেন দিয়ে গার্ডার ওঠানো হচ্ছে, সে ক্রেন গার্ডারের ভারে কাত হয়ে গেছে। প্রকল্পটি কতটা অপেশাদার ও ঢিলেঢালাভাবে চলছে সেটা বোঝা যায়, পাঁচ বছরের প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ না হওয়ার মাধ্যমে। ২০১২ সালে নেওয়া প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে ১০৯ শতাংশ। ১০ বছর হওয়ার পর কাজ হয়েছে ৮১ শতাংশ।

বলা বাহুল্য, দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অধিকাংশের অবস্থাই তথৈবচ। প্রকল্পগুলো নির্দিষ্ট মেয়াদে শেষ হয় না; সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। ভোগান্তির পাশাপাশি দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানির অঘটনও কম নয়। গত মাসে বিআরটি প্রকল্পেই গাজীপুর শহরে গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে একজন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। গত বছর বিমানবন্দর এলাকায় এবং আবদুল্লাহপুরে একই দিনে দু'বার গার্ডার ধসের ঘটনায় ছয়জন আহত হন, যাঁর মধ্যে নির্মাণকাজে যুক্ত তিনজন চীনা নাগরিকও ছিলেন। তাছাড়া এ বছরের মে মাসে মেট্রোরেলের মিরপুর-১১ নম্বর অংশে নির্মাণাধীন পিলার থেকে ইট পড়ে এক পথচারী নিহত হন। যে মানুষের জন্য উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ সে মানুষই যদি এর শিকার হয়, এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে।

আমাদের সড়ক এমনিতেই দুর্ঘটনাপ্রবণ। খোদ রাজধানীতেই ক'দিন দুর্ঘটনায় পথচারী মারা যান। পাল্লা দিয়ে গণপরিবহন চালাতে গিয়ে বলি হন যাত্রী। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িও যেন মৃত্যুদূত। এমন অনিরাপত্তার মধ্যেই প্রতিদিন চলতে হয় রাজধানীবাসীর। মঙ্গলবার গার্ডার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র বিআরটি প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রকল্পের দায়িত্বশীলরা এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। প্রকল্প পরিচালক, ঠিকাদার ও পরামর্শকরা হয়তো স্বস্তিতেই আছেন। কিন্তু যে নবদম্পতি চোখের সামনে পাঁচ স্বজন হারিয়েছেন, তাঁদের ট্রমা কি আমরা দেখছি! আজ তাঁরা স্বজন হারিয়েছেন। এমন ঢিলেঢালা ভাব চলতে থাকলে কাল হয়তো আমরাও এর শিকার হতে পারি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে কি?

সমকাল অনলাইনে প্রকাশিত ১৬ আগস্ট ২০২২

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।