Mahfuzur Rahman Manik
অভিবাদন, পারিসা!
জুলাই 25, 2022

মানুষ সাহায্যের পরিবর্তে ভিডিও করে- 'সাহসী কন্যা' পারিসা আক্তারের এ অভিযোগ খণ্ডানো এতটা সহজ নয়। কারণ তিনি নিজেই এর শিকার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থী তাঁর ছিনতাই হয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন উদ্ধার করতে না পারলেও আরেক ছিনতাইকারীকে ঠিকই ধরেছেন এবং অন্যজনের মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছেন। বৃহস্পতিবার চিড়িয়াখানা থেকে আসার পথে কারওয়ান বাজারে বাস থেকে যখন তাঁর মোবাইল ফোনটি ছিনতাই হয়ে যায়; তিনি নিজেই গাড়ি থেকে নেমে ছিনতাইকারীকে ধাওয়া করেন এবং তাঁর মোবাইল ফোন উদ্ধারে মানুষের সাহায্য চান। তাঁর আক্ষেপ- ডাকে কেউই সাড়া দেয়নি; কিন্তু তিনি দমে যাননি। আরেক ছিনতাইকারীকে তিনি একাই পাকড়াও করেন এবং নিজের সাহসিকতায় তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন বের করে আনতে সক্ষম হন। সে চিত্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখেছে। কেউ আবার ভিডিও করেছে।

এমন চিত্র অন্য ঘটনায়ও আমরা দেখেছি। কেউ হয়তো মারধরের শিকার হয়েছেন; তাঁকে কেউ উদ্ধার না করে পাশ থেকে ভিডিও করছেন কিংবা ছবি তুলছেন! অথচ ভিডিও করা কিংবা ছবি তোলায় মনোযোগ না দিয়ে তৎক্ষণাৎ এগিয়ে যাওয়া জরুরি ছিল। রোববার প্রকাশিত প্রতিবেদনে সমকালের সঙ্গে পারিসা আক্তার আরও বলেছেন, কারও বিপদ হলে পাশের কেউ এগিয়ে না এসে বরং না দেখার ভান করে এড়িয়ে যান। এখন এই দুই শ্রেণির মানুষেরই প্রাধান্য- কেউ বিপদে এগিয়ে না এসে পাশ কাটিয়ে চলে যান, আবার কেউ তাঁর কাছে থাকা মোবাইল ফোনটির সদ্ব্যবহার করেন ছবি তোলা কিংবা ভিডিও করার মাধ্যমে। অথচ নিজে উদ্ধারে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেন না।

অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ কিংবা কেউ বিপদে পড়লে তাঁকে উদ্ধার করা সামাজিক মানুষের স্বাভাবিক গুণ। এটা হয়তো সত্য, অনেক সময় কাউকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে গেলে নিজেই বিপদের মুখোমুখি পড়তে হয়। তার পরও অবস্থার আলোকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়াই প্রত্যাশিত। সাধারণ ছিনতাই বা চুরির ঘটনায় সামনে থাকা মানুষের উচিত এগিয়ে আসা। একইভাবে যখন দু'জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি থেকে ধরাধরির পর্যায়ে চলে যায়, কিংবা কেউ যখন কাউকে মারছে তখন তাদের ছাড়িয়ে দেওয়া বা রক্ষা করার জন্য এগিয়ে যাওয়া জরুরি।

এখনও সে চর্চা হারিয়ে গেছে, বলা যাবে না। বিশেষ করে গ্রামে তা দেখা যায়। সেখানে একে অপরের প্রয়োজনে মানুষ এগিয়ে যায়। বিপদে মানুষ পাশে দাঁড়ায় কিংবা অন্যায়ে কেউ চুপ করে থাকে না। গ্রামে পরস্পরকে চেনে বলেও এটি সহজ হয়। কিন্তু শহরের পরিস্থিতি ভিন্ন। শহরে অপরিচিত মানুষ বলেই কারও বিপদে পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে দ্বিধা থাকে। তা ছাড়া নানা ধরনের বিপথগামী চক্রের ফাঁদে পড়ার শঙ্কা থাকে বলেও অনেকে নিজেকে পাশ কাটিয়ে চলেন। সতর্কতা সাধুবাদযোগ্য। তার পরও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিবাদ করা কিংবা বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়ানোই মানবিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব থেকে যখন অধিকাংশই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত; তখন যাঁরাই প্রতিবাদ করছেন কিংবা সাহস করে এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হন কিংবা সংবাদমাধ্যমে খবর হয়ে আসেন।

সে জন্যই এখন খবর হয়- 'মানবতা এখনও মরেনি।' এমন একটা স্বার্থপর ও বিপজ্জনক সমাজে আমরা বাস করছি, যেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদকারীর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। কেউ উচিত কথা বললে তাঁকে বিপদে পড়তে হয়। তাই বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিবাদকারীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। যেন অন্যায় মেনে নিয়ে মুখ বুজে থাকলেই ভালো থাকা যায়। কিন্তু এমন স্বার্থপর মানুষও কি ভালো থাকে? তারা কি আত্মদংশনে ভোগে না?

নারী হিসেবে এ সমাজে পারিসা আক্তারের হিসাব-নিকাশ আরও বেশি। এই জটিলতার মধ্যেও তিনি যেভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদে নেমেছেন; যেভাবে ছিনতাইকারীর পেছনে একাই দৌড়েছেন; যেভাবে ছিনতাইকারীকে ধরে অন্যের ফোন উদ্ধার করেছেন, সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। অভিবাদন, বোন পারিসা।

সমকালে প্রকাশ ২৫ জুলাই ২০২২

ট্যাগঃ , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।