গত ২৫ জুলাই পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবসে আমরা জেনেছি বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এত শিশু যখন এক প্রতিরোধযোগ্য কারণে মৃত্যুবরণ করে সেটি আমাদের জন্য কতটা দুর্ভাগ্যজনক, বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রস্তাবেই ২০২১ সাল থেকে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস পালন হচ্ছে, তারপরও নীরব এ মহামারি বাংলাদেশেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। ২৫ জুলাই যখন দিবসটি আমরা পালন করেছি, ওই দিনই পঞ্চগড়ে পুকুরে পড়ে ভাইবোনের মৃত্যু ঘটে। ৬ ও ৮ বছরের একই পরিবারের দুটি শিশুর মৃত্যু কতটা বেদনাদায়ক, তা ভুক্তভোগী পরিবারই জানে। তার চেয়েও হতাশাজনক পানির দেশের মানুষ পানিতে পড়েই মারা যাচ্ছে!
পানিতে পড়ে মৃত্যুর একটা প্রধান কারণ সাঁতার না জানা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া। গ্রামীণ এলাকায় পুকুর-খাল-ডোবাসহ পানির আধার খোলামেলা থাকে। সেগুলোতে পড়ে শিশুর মৃত্যু ঘটে সাধারণত মা-বাবা-অভিভাবকের অসচেতনতায়। অসচেতনতা একদিকে যেমন শিশুর দেখাশোনার ক্ষেত্রে, অন্যদিকে সময়মতো শিশুকে সাঁতার না জানানোর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। আমরা দেখছি, গ্রামে অনেক শিশু এমনকি তিন বছরেই সাঁতার শিখে যাচ্ছে। শিশু যেখানে দুই বছরের মধ্যেই দৌড়াতে পারে, কথা বলতে পারে সেখানে তিন-চার বছরে সাঁতার শেখা কঠিন কিছু নয়। শিশুকে সাঁতার শেখানো গ্রাম-শহর সর্বত্র জরুরি।
এটা সত্য, বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে মৃত্যুর অঘটন বেশি ঘটে। এ সময়ে চারদিকে পানি থাকে। বন্যা হলে তো কথাই নেই; বাড়িঘর সব পানিতে ভেসে যায়। তখন শিশুরাও অনিরাপদ হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় শিশুর নিরাপত্তায় অভিভাবককে বেশি সতর্ক হতে হয়। একেবারে বাচ্চাদের বাইরে অন্তত পাঁচ বছরের শিশু যাতে নিজেই নিজের জরুরি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে, সেখানেও অভিভাবকের দৃষ্টি প্রয়োজন। সাঁতার জানলেও গভীর পানিতে পড়লে হয়তো ৪-৫ বছরের শিশু ভয় পেয়ে যেতে পারে এবং তাল সামলে নিতে না পেরে ডুবেও যেতে পারে। কিন্তু ৬ কিংবা ৮ বছরের কোনো শিশুর পানিতে পড়ে মৃত্যুর খবর কেন আমাদের দেখতে হবে?
অবশ্য পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর অঘটন কেবল বাংলাদেশের নয়, বিশ্বেরও সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পানিতে ডোবা বিশ্বব্যাপী দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর পানিতে ডুবে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। পানিতে ডুবে মৃত্যুর প্রতি ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টি ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
বিশ্বে পানিতে ডুবে মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান উদ্বেগজনক পর্যায়ে থাকলেও তা প্রতিরোধে আমাদের উদ্যোগ সে পর্যায়ে নেই। জাতীয় এ সংকট মোকাবিলায় পারিবারিক ও প্রশাসনিক উভয় উদ্যোগ জরুরি। প্রশাসনিক দু'ধরনের উদ্যোগ হতে পারে- জনসচেতনতা এবং সাঁতার প্রশিক্ষণ। জনসচেতনতার ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকে সাঁতারের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।
সাঁতারের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন সেভাবে দেখা যায়নি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সমকালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, '৪ কোটি টাকার সুইমিংপুলে সাঁতার কেবল এক দিন।' প্রতিবেদন অনুসারে, শহুরে শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখাতে চার কোটি টাকা ব্যয়ে সুইমিংপুল নির্মাণ করেছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু সুইমিংপুলটিতে মাত্র এক দিনের জন্য সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল, এরপর চার বছর ধরে তা পরিত্যক্ত অবস্থায়। এ বছরের জুনে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, সুরক্ষা ও সাঁতার সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে ৫ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে এই সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ২৭১ কোটি টাকার ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন এ মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি।
শিশুরা যাতে দ্রুত সাঁতার শেখে সেজন্য পারিবারিক সচেতনতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাঁতার শেখা সাক্ষরতার মতোই জীবনের জন্য জরুরি- এ বোধ জাগ্রত হলে পরিবারগুলো নিজেরাই শিশুদের সাঁতার শেখাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। শহরের শিশুরা যাতে সাঁতার শিখতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সুইমিংপুল নির্মাণসহ সহজ শর্তে সাঁতারের ব্যবস্থা করা দরকার।