Mahfuzur Rahman Manik
বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন থাকলেও মনোভাব তৈরি হয়নি

সাক্ষাৎকার: হাসান আলী

সাক্ষাৎকার গ্রহণ :মাহফুজুর রহমান মানিক

হাসান আলী প্রবীণদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে উদ্যোগ এজিং সাপোর্ট ফোরামের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশ জেরোন্টোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ। শিক্ষক, উন্নয়নকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী ও ব্যবসায়ী হিসেবে দীর্ঘ ৩০ বছর কাজ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। হাসান আলী ১৯৬৩ সালে চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

সমকাল: প্রবীণদের নিয়ে আপনি কোন প্রেরণা থেকে কাজ করছেন?
হাসান আলী: আমি আমার পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের কষ্টকর জীবন দেখেছি। আমাদের আশপাশ থেকেও প্রবীণদের নানামুখী সংকট প্রত্যক্ষ করেছি। ছোটবেলা থেকেই আমি প্রবীণদের প্রতি সংবেদনশীল। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন থেকেই কয়েকজন মিলে প্রবীণদের চিকিৎসা, হাসপাতালে সেবা, রক্ত দেওয়াসহ নানা কাজে যুক্ত হই।
সমকাল: বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা নামে একটা দিবস কেন প্রয়োজন?
হাসান আলী: জাতিসংঘ দিবসটি ২০১১ সাল থেকে পালন করছে। দিবসটির প্রয়োজনীয়তা অনেক। কারণ বিশ্বব্যাপী প্রবীণরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার।
সমকাল: দেশের প্রবীণদের অবস্থা কেমন?
হাসান আলী: প্রবীণরা আমাদের দেশে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন। শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিক, আবেগিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। গালাগাল করা, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া, কথা বন্ধ করে দেওয়া প্রভৃতি মানসিক নির্যাতন তাঁদের সইতে হয়। অর্থকড়ি, জমিজমা, স্বর্ণালংকার, বাড়িঘর কৌশলে কিংবা চাপ সৃষ্টি করে বেহাত করা হয়। তাঁদের পছন্দের কাজও করতে দেওয়া হয় না।
সমকাল: এসব নির্যাতন কতটা প্রকাশ হয়?
হাসান আলী: আমাদের দেশের প্রবীণরা নির্যাতনের শিকার হলেও মানসম্মানের ভয়ে তা প্রকাশ করতে চান না। অল্প কিছু মানুষ বাধ্য হয়ে থানা পুলিশ, আইন আদালতের দ্বারস্থ হন। আমি মনে করি, এ নির্যাতন বন্ধে গ্রাম-শহর, পাড়া, ওয়ার্ডভিত্তিক প্রবীণের তালিকা তৈরি করে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা যেতে পারে। সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও মানুষকে সচেতন করা যায়।
সমকাল: প্রবীণরা অবহেলারও শিকার।
হাসান আলী: প্রবীণদের প্রতি অবহেলা কম নয়। তাঁদের অনেকেরই প্রত্যাশিত অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান কিংবা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তাঁরা মানসিক সমস্যায় দিন কাটান। অনেকেরই আয়ের উৎস না থাকায় অর্থনৈতিক সংকটে ভোগেন। তা ছাড়া ব্যক্তি হিসেবে সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, বিনোদনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করার বিষয়ও রয়েছে।
সমকাল: প্রবীণদের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ কেমন?
হাসান আলী: প্রবীণদের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রতিটি বিভাগে প্রবীণ নিবাস রয়েছে। বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন অনেক প্রবীণ। কোনো কোনো হাসপাতাল প্রবীণদের জন্য জেরিয়েট্রিক ওয়ার্ড চালু করেছে। পিকেএসএফ সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে দুই শতাধিক ইউনিয়নে প্রবীণ জীবনমান উন্নয়নে কাজ চলছে। বিভিন্ন এনজিও নিজ নিজ কর্মএলাকায় প্রবীণদের জন্য কাজ করে। প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি সারাদেশে প্রবীণদের জন্য কাজ করে।
সমকাল: প্রবীণদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তাদের চাহিদাও নিশ্চয় বাড়ছে।
হাসান আলী: অবশ্যই। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়; বিশ্বের অনেক দেশেরই চ্যালেঞ্জ। উল্লেখ করা দরকার, যদিও পুরোনো হিসাব, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০১৭ সালে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে এক সম্মেলনে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য পাঁচটি প্রধান ঝুঁকি চিহ্নিত করে। এর একটি হলো বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনে একজন প্রবীণ হবে। বিপুলসংখ্যক প্রবীণ মানুষের ভরণ-পোষণ, সেবা-যত্ন, ওষুধ-পথ্য ও চিকিৎসার জন্য বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় হবে।
সমকাল: প্রবীণ নিবাসগুলোর অবস্থা কী?
হাসান আলী: আমার বাংলাদেশের অধিকাংশ বৃদ্ধাশ্রম ও প্রবীণ নিবাস পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে। এগুলোতে দেড়-দুই হাজার প্রবীণ বসবাস করেন। সরকারের ছয় বিভাগে ছয়টি প্রবীণ নিবাসে বসবাস করার জন্য লোক না পাওয়ায় তা সেফহোম হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৫০০ শয্যার প্রবীণ নিবাসে পাঁচজন থাকেন। দেড় হাজার প্রবীণের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে গাজীপুর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। অথচ সেখানে বসবাস করেন প্রায় ২০০। আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে আছেন ৪০ জন।
সমকাল: তার মানে, এগুলোর প্রয়োজন নেই?
হাসান আলী: বৃদ্ধাশ্রম ও প্রবীণ নিবাসের প্রয়োজন হলেও সে মনোভাব তৈরি হয়নি। আমাদের মধ্যে বৃদ্ধাশ্রম ও প্রবীণ নিবাস সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। আমরা আমাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য ছাত্রাবাস, হোস্টেল, বোর্ডিং, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠাতে পারি। অথচ বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ নিবাসে প্রবীণদের পাঠাতে চাই না। বিভিন্ন কারণে অনেকের পক্ষেই সন্তানের সঙ্গে বসবাস করা সম্ভব হয় না। আবার সন্তানদের নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে মা-বাবাকে সঙ্গে রাখতে পারছেন না। নতুন পরিস্থিতিতে সমবয়সী সমমনা প্রবীণরা একত্রে থাকার সুযোগ পেলে ভালো থাকবেন।
সমকাল: সরকার পিতামাতার ভরণপোষণে আইন করেছে।
হাসান আলী: আমি মনে করি, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩ সংসদে পাস হওয়ার পর সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। মানুষ বুঝতে পেরেছে, পিতামাতার ভরণপোষণ না করলে আইনের চোখেও অপরাধী হতে হবে। আমাদের দেশের মা-বাবা সন্তানের বিরুদ্ধে পারতপক্ষে আইনের আশ্রয় নিতে চান না। মুখ বুজে নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে যান। এই আইনের আওতায় কয়েকটি মামলাও হয়েছে।
সমকাল: প্রবীণদের জন্য চিকিৎসাক্ষেত্রে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
হাসান আলী: প্রবীণরা সাধারণত বাত, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, যক্ষ্ণা, ক্যান্সার, লিভারের রোগসহ নানা ধরনের অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। তাঁদের চিকিৎসা ও যত্ন নিশ্চিত করতে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বিশেষায়িত প্রবীণ হাসপাতাল জরুরিভাবে নির্মাণ করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত প্রবীণদের নামমাত্র বা বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়ার সুযোগ রাখতে হবে। টিকা কর্মসূচির আওতায় প্রবীণদের জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার প্রতিষেধক টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।
সমকাল: প্রবীণদের জন্য কমিউনিটি কেয়ার সার্ভিস কতটা জরুরি?
হাসান আলী: আমাদের প্রবীণরা পরিচিত পরিবেশে বসবাস করতে চান। নিজের বাড়িঘরে সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে পছন্দ করেন। অচেনা-অজানা পরিবেশে শারীরিক ও মানসিকভাবে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রবীণকে তাঁর বাড়িতে পরিচিত স্থানে প্রশিক্ষিত সেবাকর্মীর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা দরকার। প্রয়োজনে সামাজিকভাবে সেবামূল্য জোগাড় করতে হবে।
সমকাল: আমাদের গণপরিবহন,পথ পারাপার, চলাচল কতটা প্রবীণবান্ধব?
হাসান আলী: প্রবীণদের বড় একটা অংশ দরিদ্র হওয়ার কারণে তাঁরা গণপরিবহনে চলাচল করেন। গণপরিবহনে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় তাঁদের অনেক সময় দাঁড়িয়ে যেতে হয়। সাশ্রয়ী মূল্যে টিকিট সংগ্রহ করতে পারলে প্রবীণদের চলাচল আনন্দের হতো। পথ পারাপার প্রবীণদের জন্য বেশ কষ্টের। বিশেষ করে ফুট ওভারব্রিজ পার হওয়া। ফুটপাতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকায় চলাচল তাঁদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
সমকাল: সর্বজনীন পেনশন সুবিধা কেমন হওয়া উচিত?
হাসান আলী: সর্বজনীন পেনশন মানে ষাটোর্ধ্ব সব প্রবীণ পেনশন পাবেন। সরকারের কাছ থেকে তাঁদের পেনশন পাওয়া উচিত, যাঁদের আয়ের অন্য কোনো উৎস নেই বা থাকলেও অপর্যাপ্ত। সর্বজনীন পেনশন চালু করার সময় সুবিধাবঞ্চিত প্রবীণদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে অর্থাৎ অতি দরিদ্র প্রবীণদের বেশি করে টাকা দিতে হবে, যাতে তাঁরা সম্মানের সঙ্গে জীবন কাটাতে পারেন।
সমকাল: অনেক দেশে প্রবীণদের জন্য মানসিক সক্ষমতা আইন রয়েছে। এ আইন আমাদের জন্য কতটা জরুরি?
হাসান আলী: মানসিক সক্ষমতা আইন হলে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তির কল্যাণে আইনে স্বীকৃত ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। যেমন সম্পত্তি হস্তান্তর, ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন, চিকিৎসার খরচ প্রদান, পাওনা টাকা আদায়, দেনা পরিশোধ, আদালতে মামলা পরিচালনা ইত্যাদি।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
হাসান আলী: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সমকালে প্রকাশিত ১৫ জুন ২০২২

ট্যাগঃ , , , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।