Mahfuzur Rahman Manik
শ্রীলঙ্কার 'নতুন' প্রধানমন্ত্রীর পুরোনো চ্যালেঞ্জ
প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবিতে এক মাস ধরে আন্দোলন চলছে শ্রীলঙ্কায়

মূল লেখক: মারিও আরুলথাস

ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

শ্রীলঙ্কায় ২০১৯ সালের বোমা হামলার পর গত সপ্তাহের গণবিক্ষোভে বিস্ম্ফোরণ ছিল সবচেয়ে বড় ঘটনা। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবিতে গত এক মাস ধরে কলম্বোতে যে আন্দোলন চলছিল; সেখানে সরকার সমর্থকরা হামলা চালায়। আন্দোলনকারীরা পাল্টা প্রতিশোধ নেয়। ওই সময় সহিংসতায় নিহত হয় ৮ জন। সরকারি দলের শতাধিক নেতাকর্মীর বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর প্রেসিডেন্টের ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করেন এবং পালিয়ে রক্ষা পান।

এখন মাহিন্দা রাজাপাকসের জায়গায় নতুন মুখ এসেছে। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন দেশটির ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে। এর আগে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হলেও কোনোবারই তিনি মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দশকের পর দশক ধরে চলা শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং জনতুষ্টিমূলক সিদ্ধান্তের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের জের ধরেই মাহিন্দা রাজাপাকসের অবিশ্বাস্য পতন হয়।
মাত্র দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার জাতীয় নির্বাচনে সেখানকার বিখ্যাত রাজাপাকসে পরিবারের ভূমিধস জয় হয়। তারা দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয় পায়। রাজাপাকসেরা ক্ষমতায় আসীন হন। ২০১৯ সালে গোটাবায়া তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এভাবে শ্রীলঙ্কার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাজাপাকসে পরিবারের ক্ষমতা ও আধিপত্য নিশ্চিত হয়। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা ছাড়াও রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রাণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বর্তমান পার্লামেন্টে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) একমাত্র প্রতিনিধি রনিল বিক্রমাসিংহে। যদিও তাঁর দল রাজনীতিতে এক সময় বেশ শক্তিশালী ছিল। কিন্তু গত নির্বাচনে ইউএনপি দলের ভরাডুবি হয়।

২০১৯ ও ২০ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর ক্ষমতা ধরে রাখতে সব রকম ব্যবস্থা নেয় এবং তামিল ও মুসলিমদের বেকায়দায় ফেলার আয়োজন সম্পন্ন করে রাজাপাকসে পরিবার। তামিল এলাকায় সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন বৃদ্ধি করা; তামিল, সাংবাদিক ও এনজিও কর্মীদের হেনস্তাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে রাজাপাকসের সরকার এটা বোঝায়- সিংহলিদের বাইরের সম্প্রদায় শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। শ্রীলঙ্কার সিংহলি অধ্যুষিত দক্ষিণাংশে মানবাধিকার কিংবা জবাবদিহির দাবিতে বিক্ষোভ না হলেও বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে তারাও আন্দোলনে যোগ দেয়।

রাজাপাকসেরা 'ভিস্তাস অব স্পেল্গন্ডোর' বা সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিলেও এর বিপরীতে বাস্তবে তারা এনেছেন দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক দৈন্য। এর ফলেই সরকারের বিরুদ্ধে এই অভূতপূর্ব আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের হেনস্তা এবং জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। কলম্বোতে সামরিক যান টহল দিচ্ছে। কারফিউর কারণে বিভিন্ন চেকপোস্টে যানবাহন আটকে তল্লাশি করা হচ্ছে। সেখানে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা হুঁশিয়ার করে বলেছে, তারা সশস্ত্র প্রতিবাদীদের গুলি করবে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন ও প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা সরকারের নিন্দা জানিয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, চলমান বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারকে সীমিত করেছে। জরুরি আইন দ্রুত বাতিল করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করেই বিক্ষোভকারীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে এবং ধ্বংস করা তাঁবু তারা পুনরায় খাড়া করছে। সিংহলি নাগরিক সমাজ ও বিরোধী দলগুলো বিক্ষোভে সরকারি আক্রমণের নিন্দা জানিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছে।

প্রেসিডেন্ট গোটাবায়াকে তার পদে আসীন রাখার জন্যই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অনেকে বলছেন। তারই আলোকে আশা করা হচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের আন্দোলনেরও সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা এখনও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এবং প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ার পদত্যাগ দাবি করছে। তাদের নিবৃত্ত করা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।

প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে তামিলদের কাছে পরিচিত শত্রু। স্বাভাবিকভাবেই মূল তামিল জাতীয়তাবাদী দলগুলো তার নিয়োগের নিন্দা জানিয়েছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এমনকি দাবি করেছেন, তিনি মাহিন্দা রাজাপাকসেকে 'ইলেকট্রিক চেয়ার' তথা সাজার কাঠগড়া থেকে উদ্ধার করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অপমানিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন।

রনিল বিক্রমাসিংহে জাতিগত সংঘাত নিরসনে বৌদ্ধ মতবাদকে সমাধান হিসেবে তুলে ধরার কারণে তামিল জনগণের চক্ষুশূল হয়ে আছেন। তামিলদের একটি রাজনৈতিক সমাধানের দাবিই যখন জাতিগত সংঘাতের মূল কারণ, সেখানে ভূমিকার ক্ষেত্রে বিক্রমাসিংহে এবং রাজাপাকসে পরিবারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তামিলদের রাজনৈতিক অধিকার সংকোচন, তামিল অধ্যুষিত শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে নিরস্ত্রীকরণ, যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহি প্রভৃতি দাবির কারণে চলমান আন্দোলনে তামিল অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাংশের জনগণ যদিও রনিল বিক্রমাসিংহেকে দেশটির জন্য নতুন মুখ হিসেবে দেখছে, কিন্তু অনেক তামিলের কাছে বিষয়টি ক্ষোভের। তা ছাড়া দেখা যাচ্ছে, সিংহলি সামরিক বাহিনী তাদের সম্প্রদায়ের ওপরেই বন্দুক তাক করছে। পার্লামেন্টে তামিল সদস্য গাজেন পনাবলাম ২০২০ সালে সংসদে এক জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, শ্রীলঙ্কা সিংহলি জনতার বিরুদ্ধেও যেতে পারে। যার সত্যতা এখন স্পষ্ট। যদিও চলমান সিংহলি বিক্ষোভে সামরিক বাহিনী যতটা না রয়েছে, তার চেয়ে বেশি রয়েছে উত্তর-পূর্বের তামিল বিক্ষোভে। তারা তামিল জনগণকে প্রায় সবদিক থেকে ঘিরে রয়েছে। এমনকি তামিলদের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও তাদের হস্তক্ষেপ এমনভাবে বিরাজমান, যেখান থেকে মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব। তিন লক্ষাধিক সৈন্য সাতটি আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটিই রয়েছে তামিল অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বে। যেটি পুরো শ্রীলঙ্কার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। দশকের পর দশক ধরে সহিংসতার কারণে তামিলদের বিরুদ্ধে এক ধরনের ঘৃণা বিরাজমান। যুদ্ধ শেষ হলেও সেখানে সশস্ত্র বাহিনীর দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি বিদ্যমান।

১৮ মে তামিলরা গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন করবে। ঐতিহ্যগতভাবে দিনটিতে তামিলরা জমায়েত হয়। গত বছর এই দিবসের অনুষ্ঠান পালনের কারণে ১০ তামিলকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং আরও অনেকেই নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ভীতি প্রদর্শন ও হেনস্তার শিকার হয়। নিহতদের স্মরণে তামিলদের গড়া একটি স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলা হয়। এ বছর ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়াবিরোধী বিক্ষোভের বিরুদ্ধে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। পুলিশ তামিল বেসামরিক নাগরিকদের হুমকি দিয়ে বলেছে, কেউ অবৈধভাবে জমায়েত হলে তাদের গুলি করার আদেশ রয়েছে। যেহেতু শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে তামিলরা গণহত্যা স্মরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সুতরাং বলাই যায়, এটি হবে বিক্রমাসিংহের জন্য আগাম পরীক্ষা। দক্ষিণাঞ্চলেও ১৮ মে প্রেসিডেন্টবিরোধী বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়া দেখার বিষয় রয়েছে। কারণ সিংহলিরা সাধারণত দিনটি 'বিজয়' দিবস হিসেবে পালন করে। সুতরাং পুরোনো একজন প্রধানমন্ত্রী, যিনি ষষ্ঠবারের মতো এ পদে আসীন হলেন, এই সময়ে তিনি কী পদক্ষেপ নেন তাই দেখার অপেক্ষা। তামিলদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তারা যা করেছে, এখনও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে কিনা, সেটা দেখার বিষয়। এর মাধ্যমেই বোঝা যাবে- শ্রীলঙ্কায় সব নাগরিকের জন্য স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির বিষয়টি অধরা থাকছে কিনা।

মারিও আরুলথাস: পিপল ফর ইকুয়ালিটি অ্যান্ড রিলিফ ইন লঙ্কা (পার্ল)-এর উপদেষ্টা: আলজাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।