Mahfuzur Rahman Manik
মোদি সরকার টিকা নিয়ে বৈষম্য করছে-সোনিয়া গান্ধী

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী সম্প্রতি করোনাদুর্যোগ, টিকা ও সেখানকার সাম্প্রতিক সংকট নিয়ে দেশটির জাতীয় দৈনিক দ্য হিন্দুর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক সন্দ্বীপ ফুকান। ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক।


দ্য হিন্দু: করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত। সাম্প্রতিক ইতিহাসে ভারতে সবচেয়ে বেশি জনস্বাস্থ্য সংকট স্পষ্ট। এ সংকটের জন্য দায় কার?

সোনিয়া গান্ধী: ভারতের এ জাতীয় বিপর্যয়ে আমার মনে হয় একটি সম্মিলিত ব্যাপক প্রচেষ্টা দরকার। আমাদের একসঙ্গে কাজ করে প্রয়োজনীয় সব জরুরি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। টিকা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে যত দ্রুত সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তবে এটা বলতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকার কয়েক মাস আগে করোনা নিয়ন্ত্রণের এক অকালপকস্ফ বিজয় উদযাপন করেছিল। সেখানে বাস্তবতা ছিল উপেক্ষিত। এমনকি সংসদীয় কমিটি করোনার প্রস্তুতির জন্য যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলোও আমলে নেওয়া হয়নি। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ভারত ও বিশ্বের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অন্যান্য দেশের অবস্থার আলোকে আমাদের সতর্ক করে বলেছেন, কী ঘটতে পারে। অথচ আমরা তাতে কর্ণপাত না করে প্রগল্‌ভ অহংকার আর আত্মতুষ্টিতে ভুগেছি। করোনা সংক্রমণের প্রভাবের কথা চিন্তা না করেই ভাইরাসটি আরও ছড়ানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।

দ্য হিন্দু: এখন তাহলে করণীয় কী?

সোনিয়া গান্ধী: এখন ব্লেম গেম খেলার সময় নয়। বরং আমাদের করণীয় হলো, মানুষের জীবন রক্ষা করা। মানুষের বেদনা উপশম করা। আমাদের লাখ লাখ নাগরিকের দুর্ভোগ লাঘব করা। অক্সিজেন সংকট দূর করা। জরুরি ওষুধ এবং হাসপাতালে আসনের ব্যবস্থা করা। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও সব রাজ্যে এ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। আমরা যেভাবে পারছি, এ সহযোগিতা করে আসছি।

কৃতিত্ব নেওয়া বা এটা প্রচারের সময় এখন নয় যে, আমরা রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কী করছি। কোনো ধরনের প্রচারণা পাওয়ার আশা ছাড়াই কাজ করার সময় এখন। আমি এখানে ধন্যবাদ দিতে চাই, বিশেষ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যারা গত কয়েকদিন ধরে আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে।

তবে এটা সত্যিই বেদনাদায়ক, সরকার এখনও অগ্রাধিকারের বাইরে অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প। বেহুদা এখন প্রকল্পটি নির্মাণের কাজ চলছে। তবে যেসব সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগ ত্রাণসহ অন্যান্য সাহায্য নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের প্রশংসা করতেই হবে। একই সঙ্গে আমাদের সম্মুখযোদ্ধা স্বাস্থ্যকর্মীবৃন্দ যারা ঝুঁকি নিয়ে মানুষের সেবা দিচ্ছে, তাদের ঋণ শোধ করার মতো নয়।

দ্য হিন্দু: সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং টিকা নিয়ে ছয়টি পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন। রাহুল গান্ধী এবং আপনিও প্রধানমন্ত্রীর কাছে কিছু পরামর্শ দিয়ে চিঠি লিখেছেন। তার সমালোচনাও রয়েছে। বলা হচ্ছে, কংগ্রেস সংকট নিয়ে রাজনীতি করছে।

সোনিয়া গান্ধী: হ্যাঁ, ড. মনমোহন সিং তার গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে খুবই ঐকান্তিক, মর্যাদাসম্পন্ন ও গঠনমূলক চিঠি লিখেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রী সে চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার তো করেনইনি, উপরন্তু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী উল্টো সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে মনমোহন সিং ও ভারতীয় কংগ্রেসকে একহাত নিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আমার মতো নিশ্চয়ই অনেককেই শোকাহত করেছে। সাবেক কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে আমি প্রধানমন্ত্রীকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চিঠি লিখেছি। সেগুলোরও কোনো অর্থবোধক প্রাপ্তি স্বীকার পাইনি। সংখ্যা উল্লেখ করে বলি, আমি গত ১৪ মাসে কেবল করোনাভাইরাস প্রসঙ্গে গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ১০টি চিঠি লিখেছি। আমি জোর করে বলছি, তারা আমাদের দলীয় ফোরামের আলোচনায় বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। কংগ্রেস শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংকট তুলে ধরেন। এখানে রাজনীতি করার কোনো প্রশ্ন নেই, এটি একটি সংকট। আমরা দায়িত্বশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল বিরোধী দল হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালন করছি।

দ্য হিন্দু: অভিযোগ রয়েছে, প্রকৃত চিত্র আড়াল করতে করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত তথ্য পরিবর্তন করা হয়।

সোনিয়া গান্ধী: আমি মনে করি, এটি পরিস্কার, সরকার আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে প্রকৃত চিত্র আরও বেশি মারাত্মক। আমি বিষয়টি দায়িত্ব নিয়েই বলছি, তথ্যে অধিকাংশ পরিবর্তনই রাজ্য পর্যায়ে করা হয়। যেমন উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও মধ্য প্রদেশ ইত্যাদিতে। বিষয়টি গণমাধ্যমেও স্পষ্ট হয়েছে। আসলে ২০১৪ সাল থেকে মোদি প্রশাসনেও এভাবে নানা তথ্য নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তন করা হয়েছে।

দ্য হিন্দু: আপনি সম্প্রতি বলেছেন, মোদি সরকার যেভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করছে, এটি একটি 'সম্পূর্ণ বিপর্যয়'। সরকার যা-ই করছে, বিরোধী দল তার কেবল সমালোচনাই করছে?

সোনিয়া গান্ধী: কয়েকটি বিষয় রয়েছে, তা বলতেই হবে- কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে রাজনীতি এবং বৈষম্য করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সবকিছু, সব রাজ্য যখন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত, তখন ভালো কিছু হলে তার ক্রেডিট কেন্দ্রীয় সরকার পাবে। আর খারাপ কিছু ঘটলে তার জন্য কেন্দ্রকেই দোষারোপ করা হবে। টিকার বিষয়টি দেখুন। টিকার মূল্য নিয়ে কি রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে? এমনকি টিকার মূল্যের পুরো বিষয়টি যেভাবে পরিচালনা করা হয়েছে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তার ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। পুরো টিকা কৌশল দুঃখজনকভাবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। ঐকমত্যের সঙ্গে কাজ করতে প্রয়োজন সদিচ্ছা এবং শোনার ক্ষমতা। যদি মনে করেন, আপনিই সব জানেন। তার মানে আপনি কেবল আপনার পথই বের করলেন।

দ্য হিন্দু: আপনি টিকার সরকারি নীতির সমালোচনা করেছেন। আপনি কি মনে করেন, টিকা উৎপাদনকারীদের আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়াসহ যথার্থ মূল্য পরিশোধ করা উচিত, যাতে তারা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং চাহিদা পূরণ করতে পারে?

সোনিয়া গান্ধী: দেখুন, বিষয়টি মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার। টিকা উৎপাদনকারীদের অবশ্যই তাদের খরচ উঠিয়ে কিছু মুনাফা দিতে হবে। এটি কি সরকারের দায়িত্ব নয়? যেমন অন্যান্য দেশের সরকার উৎপাদনের ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে সাপ্লাই চেইন শক্তিশালী করেছে। অথচ মোদি সরকার ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত টিকার কোনো অর্ডারই করেনি এবং এরপর যা করেছে তুলনায় তা খুবই সামান্য।

যদি প্রত্যেক ভারতীয়ের দুটি করে ডোজ লাগে, তাহলে আমাদের ২০০ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন। সেটা খুব শিগগিরই প্রয়োজন। আমাদের দল এটি বিশ্বাস করে, এই অতিমারিতে অধিকাংশ মানুষকেই ফ্রি টিকা দেওয়া উচিত। আর এ দায়িত্ব উৎপাদকদের সঙ্গে কথা বলে কেন্দ্রীয় সরকারকেই নিশ্চিত করা উচিত। তা না করে সরকার এমন পদ্ধতি করেছে, যাতে বিভিন্ন দামে টিকা মানুষকে কিনতে হয় এবং সেটি কার্যত মুনাফাকেই উৎসাহিত করছে। এমনকি, স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, সরকার আমাদের যুব শ্রেণিকে অস্বীকার করছে যাদের বয়স ১৮ থেকে ৪৫। তাদের এ টিকা দেওয়ার জন্য আরও বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

দ্য হিন্দু: আপনার মতে, এখন কোন বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যার জন্য জাতীয় প্রচেষ্টা দরকার?

সোনিয়া গান্ধী: সন্দেহ নেই, উত্তরটি হলো টিকা প্রদান কার্যক্রম। গত জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, দুই ডোজের হিসাবে তার ১০ ভাগেরও কম পূরণ হয়েছে। টিকা সরবরাহ বৃদ্ধি ও তার প্রয়োগ দ্রুততর করা এখনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আমি এখনও বলব, ড. মনমোহন সিংয়ের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত এবং টিকার প্রাপ্যতা দেরি না করে আরও সম্প্রসারণ করা উচিত।

ট্যাগঃ , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।