Mahfuzur Rahman Manik
শিক্ষাক্ষেত্রে 'প্যারাডাইম শিফট' ঘটাবে নতুন শিক্ষাক্রম

সাক্ষাৎকার: ড. এম তারিক আহসান
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মাহফুজুর রহমান মানিক

অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইআর) ২০০১ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন। তিনি শিক্ষাক্রম উন্নয়ন-সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটি এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির সদস্য। তিনি শিক্ষায় ইকুইটি ও ইনক্লুশন বিষয়ে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং এশিয়ান জার্নাল অব ইনক্লুসিভ এডুকেশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি ইউনেস্কো, ইউনিসেফসহ একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জনকারী তারিক আহসান শিক্ষাক্ষেত্রে গবেষণা ও অবদানের জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকারের অ্যালামনাই এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৪-সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন। শিক্ষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডারস ইউনিভার্সিটি (২০০৫) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (১৯৯৮) থেকে। একই ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৯৭ সালে তিনি স্নাতকও সম্পন্ন করেন।

সমকাল: শিক্ষাক্রমের রূপরেখা চূড়ান্ত অনুমোদন হলো। বলা হচ্ছে, এটি শিক্ষায় বড় পরিবর্তন। আপনি সেখানে কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। আমরা একে বড় পরিবর্তন বলব, নাকি ইতিবাচক পরিবর্তন বলব?

এম তারিক আহসান: শিক্ষাক্রম রূপরেখা চূড়ান্ত অনুমোদনের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে যে ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তাকে আমরা বড় এবং ইতিবাচক পরিবর্তন দুটিই বলতে পারি। এটি আসলে একটি প্যারাডাইম শিফট। আমাদের দীর্ঘদিনের শিক্ষককেন্দ্রিক মুখস্থনির্ভর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া এবং লিখিত ও পাবলিক পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে একসঙ্গে পরিবর্তন করে একটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, পারদর্শিতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটানোর জন্য একটা সার্বিক সংস্কার, যা ভবিষ্যৎমুখী ও অভিযোজনে সক্ষম রূপান্তরযোগ্য দক্ষতানির্ভর এবং একই সঙ্গে সৃষ্টিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক, জ্ঞাননির্ভর, দেশপ্রেমিক, সুখী ও বিশ্বনাগরিক গঠনে ভূমিকা রাখবে।

সমকাল: প্যারাডাইম শিফটের ব্যাখ্যা যদি সংক্ষেপে বলেন?

তারিক আহসান: প্রথমত, বিষয় ধারণা ও বিন্যাসে পরিবর্তন, অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাই ১০টি বিষয় শিখবে এবং প্রচলিত মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থাকবে না। সেই সঙ্গে নবম ও দশম শ্রেণিতে সব শিক্ষার্থী কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি অকুপেশনের ওপর দক্ষতা অর্জন বাধ্যতামূলকভাবে করবে এবং দশম শ্রেণি শেষে যে কোনো একটি অকুপেশনে কাজ করার মতো পেশাদারি দক্ষতা অর্জন করবে। শিক্ষাক্রম রূপরেখার ১০টি বিষয়ের সঙ্গে মাদ্রাসা ও কারিগরি শাখার বিশেষায়িত বিষয়গুলোর যৌক্তিক সমন্বয় সাধন করা হবে। দ্বিতীয়ত হলো, শিখন-শেখানো ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন; পরীক্ষা ও সনদকেন্দ্রিক পড়াশোনার পরিবর্তে পারদর্শিতাকে গুরুত্ব দিয়ে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন চর্চা, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-শেখানো কার্যক্রম বিদ্যালয়ের বাইরেও পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে অনুশীলন। শিক্ষার্থীর ওপর চাপ কমানোর জন্য শুধু দশম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা; একাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে একাদশ শ্রেণি শেষে এবং দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে দ্বাদশ শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া; পারদর্শিতা অর্জন নিশ্চিত করা ও মুখস্থনির্ভরতা কমানোর জন্য শিখনকালীন বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রবর্তন করা; সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন প্রবর্তন।

সমকাল: নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকের হাতে মূল্যায়নের বিষয়টি থাকায় শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। আপনি কী মনে করেন?

তারিক আহসান: আমি মনে করি, শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। নতুন শিক্ষাক্রম চালু হলে শিক্ষকের পড়ানোর চিরাচরিত ভূমিকায় পরিবর্তন আসবে বলে আমার বিশ্বাস। এখানে শিক্ষক থাকবেন কেবল 'ফ্যাসিলিটেটর' বা সহযোগী হিসেবে সমন্বয়কারীর ভূমিকায়। শিক্ষকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীও নিজেকে মূল্যায়ন করবে। এ ছাড়া তার সহপাঠী এবং স্কুলের বাইরে সমাজে যার কাছে শিখবে তিনি বা তাঁরা মূল্যায়ন করবেন। মূল্যায়নে নম্বরের পরিবর্তে 'মন্তব্য' দেওয়া হবে। 'প্রারম্ভিক', 'মাধ্যমিক' এবং 'পারদর্শী' ধরনের মন্তব্য যখন দেওয়া হবে, তখন শিক্ষার্থীর আর জিম্মি হওয়ার সুযোগ থাকবে না।

সমকাল: বিষয়টি যদি আরেকটু স্পষ্ট করেন।

তারিক আহসান: আমি মনে করি, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হলে শুধু কোচিং বা প্রাইভেটই নয়, নোট-গাইড ব্যবসারও সুযোগ থাকবে না। সে ক্ষেত্রে স্কুলে ছেড়ে দেওয়া মূল্যায়ন নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়া অযৌক্তিক নয়। কেননা, এর আগে 'এসবিএ' চালুর পর শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিল বলে অভিযোগ আছে। এর নাম হয়ে গিয়েছিল 'স্যারের বাসায় এসো'। ভালো নম্বর পেতে শিক্ষকের কাছে কোচিং-প্রাইভেট পড়তে হয়েছিল। প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় শিক্ষকের হাতে সর্বময় ক্ষমতা চলে যাওয়ার সুযোগ নেই। আগেই বলেছি, শিক্ষক থাকবেন ফ্যাসিলিটেটরের ভূমিকায়।

সমকাল: নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকরা কতটা প্রস্তুত?

তারিক আহসান: বলার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষকরা যে কোনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। নতুন শিক্ষাক্রমের ক্ষেত্রেও সমান কথা। এটি বাস্তবায়নে শিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। বিপুলসংখ্যক শিক্ষক যাতে যথাযথ প্রশিক্ষণ পান, এ শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের সেটাও একটি কারণ। এ জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে ধাপে ধাপে দেশের বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে প্রস্তুত করা যায়। ইতোমধ্যে পাইলটিংয়ের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে।

সমকাল: বলা হচ্ছে, আগামী বছর থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে চালু হবে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি। এর পর ধাপে ধাপে অন্য শ্রেণিগুলোতে হবে। এর যৌক্তিকতা কী?

তারিক আহসান: শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ২০২২ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০২৭ সাল পর্যন্ত চলবে। আগেই বলেছি, এবারের শিক্ষাক্রম আসলে একটি প্যারাডাইম শিফট। সে জন্য এই প্রথম একটি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ সময় নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক প্রস্তুতির বিষয়টি যেমন রয়েছে এবং সেই সঙ্গে পুরো শিক্ষা কাঠামোকেও পরিবর্তনের সঙ্গে প্রস্তুত করা যায়। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করার ফলে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ প্রমাণনির্ভর গবেষণার ভিত্তিতে সমাধান করে সামনে এগিয়ে যাওয়া যাবে এবং ভুল হওয়ার আশঙ্কা কমবে।

সমকাল: শিক্ষানীতি ২০১০-এর সংস্কার বা নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন না করেই নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রণয়ন করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

তারিক আহসান: শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণীত হয়েছে এক যুগ আগে। এর মাঝে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেই বিবেচনায় শিক্ষানীতি ২০১০ সংস্কার অথবা একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। তবে বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশ যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মাঝে অর্জনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে, তা অর্জনের জন্য যে ধরনের মানবসম্পদ দরকার তা পেতে হলে খুব দ্রুত শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্ভাবনার দিক হলো, এ দেশের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশ এখন কর্মক্ষম বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী, যাদের জনমিতিক সুফল পেতে হলে খুব দ্রুত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের দক্ষতা ও জ্ঞান সৃষ্টির সক্ষমতা প্রদান করতে হবে। তা ছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজ পরিবর্তনের যে প্রচণ্ড গতি আমরা অবলোকন করছি, তার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্যও শিক্ষাক্রমের দ্রুত রূপান্তর দরকার। এসব বিবেচনায় শিক্ষানীতি ২০১০ সংস্কার অথবা একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তারপর শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করার মতো সময় হাতে নেই এখন বাংলাদেশের। আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষানীতি নিয়ে কাজ শুরু হবে।

সমকাল: ২০২৩ সালে চালুর জন্য বই রচনাসহ অন্যান্য প্রস্তুতি রয়েছে কি?

তারিক আহসান: জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা অনুযায়ী বিস্তারিত শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে প্রথমে। এর পরে বই ও শিক্ষক সহায়িকা তৈরির গাইডলাইন তৈরি করা হয় এবং বিধি মোতাবেক বিশেষজ্ঞ লেখক দল চূড়ান্ত করে প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করা হয় এবং বই ও শিক্ষক সহায়িকা তৈরির কাজ একসঙ্গে শুরু হয়। সব ম্যাটেরিয়াল পাইলটিংয়ের জন্য চূড়ান্ত হয়ে প্রিন্ট হয়েছে এবং পাইলটিংয়ের নির্ধারিত শ্রেণির সব শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, একাডেমিক সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে এবং ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখন-শেখানো কার্যক্রম চলছে। প্রাথমিকের ম্যাটেরিয়াল তৈরির কাজও চলছে এবং শিগগিরই পাইলটিং হবে বলে জেনেছি। পাইলটিংয়ের অভিজ্ঞতা খুবই আশাব্যঞ্জক।

সমকাল: শিক্ষাক্রম রূপরেখায় ব্যবসায় শিক্ষা, ভূগোল, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় কি নেই?

তারিক আহসান: এই শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বিষয়গুলোকে আগের মতো খণ্ডিতভাবে দেখা হয়নি। বরং বিভিন্ন পঠিত বিষয়ের সমন্বয়ে থিম গঠনের মাধ্যমে ১০টি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। পৃথিবীর যেসব দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেসব দেশের শিক্ষাক্রমে এই অ্যাপ্রোচেই (ইন্টারডিসিপ্লিনারি) বিষয় সাজানো হয়েছে এবং সফলভাবে তার বাস্তবায়ন হয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, শিক্ষার্থীর সার্বিক ধারণা অর্জন করতে হলে আন্তঃবিষয়ক সমন্বয় খুব জরুরি। একই সঙ্গে যুগের পরিবর্তনে বিষয়ের গতানুগতিক ধারণা অনেকটাই বদলে গেছে।

সমকাল: উদাহরণ দিয়ে যদি বলেন...

তারিক আহসান: যেমন, ব্যবসায় শিক্ষায় প্রয়োজনীয় জাবেদা বা টালিখাতার কাজগুলো এখন আধুনিক সফটওয়্যার দিয়ে করা যাচ্ছে। তাই ব্যবসায় শিক্ষার আধুনিক ধারণা অনুযায়ী এই সফটওয়্যারের ওপর দখল অর্জনের পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবে সৃষ্টিশীল হওয়া জরুরি। এ ছাড়া সফল উদ্যোক্তা হতে হলে যোগাযোগ, সমস্যা সমাধান, পারস্পরিক সহযোগিতা ইত্যাদি দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন। নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখাতেও একই অ্যাপ্রোচে বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে ১০টি বিষয় সাজানো হয়েছে। কাজেই সাদা চোখে ভূগোল, পদার্থবিজ্ঞান বা ব্যবসায় শিক্ষার বিষয়গুলোকে আলাদা বিষয় হিসেবে দেখা না গেলেও এই বিষয়গুলোর সব প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু এই ১০টি বিষয়ের মাঝে সমন্বিতভাবে রয়েছে।

সমকাল: নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগের বিভাজন না থাকলে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব কমে যাবে কি? আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে পড়ার ঝুঁকি আছে কি?

তারিক আহসান: প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে প্রচলিত ধারায় বিজ্ঞান শিক্ষা চালিয়ে আমরা ক'জন বিজ্ঞানী পেয়েছি? আমাদের কয়টা পেটেন্ট আছে? এর কারণ হলো, বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে দেশব্যাপী একটা বৈষম্য চলছে দীর্ঘদিন ধরে, যার ফল ভোগ করছে পুরো জাতি। প্রচলিত সিস্টেমে যে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য এই যে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়, এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা সিস্টেমিক বাধা তৈরি করে। প্রতিটি শিক্ষার্থীরই একটা পর্যায় পর্যন্ত বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ের যোগ্যতা অর্জন করা প্রয়োজন। প্রচলিত শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা সমন্বিতভাবে সামাজিক বিজ্ঞান এবং ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা সাধারণ বিজ্ঞান একটি সমন্বিত বিষয় হিসেবে পড়লেও স্বাভাবিক কারণেই এই বিষয়গুলো সেভাবে গুরুত্ব পেত না।

সমকাল: বিভাগের বিভাজন না থাকলে বৈষম্য কমবে কীভাবে?

তারিক আহসান: অষ্টম শ্রেণিতে আসলে একটা মুখস্থনির্ভর পরীক্ষার ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছি- কোন শিক্ষার্থী বিজ্ঞানে পড়বে। ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম এই শ্রেণিগুলোতে শিক্ষার্থী যখন পড়ালেখা করে, তখন তাদের আসলে বয়স কত? এর ফলে দেখা যাচ্ছে, এই বয়সেই একজন শিক্ষার্থীর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সারাজীবনের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা এবং ক্যারিয়ার তৈরির রাস্তাটা একেবারে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে মুখস্থনির্ভর তথাকথিত ভালো শিক্ষার্থীরাই শুধু বিজ্ঞান পড়বে, অন্যরা দুর্বল- এ ধরনের একটি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে আছে। আবার বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে জেন্ডারও একটা বৈষম্যের ইস্যু। এমনিতেই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ গত বেশ কয়েক বছরে কমার একটা ধারা দেখা যাচ্ছে, সেই সঙ্গে মেয়েদের অংশগ্রহণ কম। এর পেছনে একটা বড় কারণ হলো, মেয়েদের পেছনে ইনভেস্ট করতে চান না অভিভাবকরা। ফলে দেখা যাচ্ছে, মেধা থাকার পরও মেয়ে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রম বিজ্ঞান শিক্ষা সবার জন্য উন্মুক্ত করায় এসব বৈষম্য দূর হবে। তা ছাড়া নতুন রূপরেখায় বিভাগের বিভাজন না থাকলেও অষ্টম থেকে দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের গুরুত্ব অন্য বিষয়গুলোর তুলনায় বেশি রাখা হয়েছে।

সমকাল: তার মানে, বিজ্ঞানের গুরুত্ব কমছে না?

তারিক আহসান: বিজ্ঞানের গুরুত্ব কমছে না, কারণ সমন্বিত বিষয় হিসেবে থাকলেও বিজ্ঞানের বিষয়গুলো যাতে অধিক গুরুত্ব পায় এবং সেই অনুযায়ী শিখন-সময় বরাদ্দ দেওয়া হয়। আবার একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে সাধারণ বিষয় যেমন- বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি শিক্ষায় এখন যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় বিষয়গুলোর ধরন পরিবর্তনের পাশাপাশি নতুন রূপরেখায় তার গুরুত্ব ও সংশ্নিষ্ট শিখন-সময় অনেকখানি কমিয়ে আনা হয়েছে, যাতে এর পরিবর্তে বিশেষায়িত বিষয়গুলোর ওপর এই স্তরে জোর দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষার যেই প্রায়োগিক একটা বড় জায়গা টেকনোলজি, আরও যদি স্পেসিফিক্যালি বলা যায়, ডিজিটাল টেকনোলজি সেটিকে বিজ্ঞান শিক্ষার অংশ হিসেবে না দেখে আলাদা একটি বিষয় হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছে। যেখানে কিনা শিক্ষার্থীরা অনেক ছোট বয়স থেকেই ডিজিটাল টেকনোলজি কীভাবে কাজ করে তা বুঝে এ বিষয়ে বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জন করবে। ফলে বর্তমান সময়ের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে শিক্ষার্থীরা আধুনিক বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠবে। এর প্রভাব পরবর্তী কর্মজগতেও পড়বে এবং ভবিষ্যৎ কর্মজগতের জন্য শিক্ষার্থীরা তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় কথা, আগের মতো একটি ছোট দলকে বিজ্ঞান শেখানোর পরিবর্তে সব শিক্ষার্থীই এখন বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে গড়ে উঠবে।

সমকাল: অনেকে বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় শিক্ষায় গুরুত্ব কম দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতা কী?

তারিক আহসান: ধর্মীয় শিক্ষায় গুরুত্ব কম দেওয়া হয়নি বরং আরও গুরুত্বপূর্ণ করা হয়েছে। ধর্ম চর্চার বিষয় বলে শিক্ষাক্রমে চর্চার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে সামষ্টিক লিখিত পরীক্ষা রাখা হয়নি। একইভাবে থিমেটিক এমন অন্যান্য বিষয় যেমন- জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়েও খাতা-কলমে কোনো পরীক্ষা নেওয়া হবে না। এগুলো প্রতিদিনের চর্চার মাধ্যমে অনুশীলন করা হবে। প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীরা যেখানে চর্চা করতে পারছে, সেখানে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় কীভাবে গুরুত্ব কম দেওয়া হলো?

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

তারিক আহসান: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।

সাক্ষাৎকারটি সমকালে প্রকাশিত ৬ জুন ২০২২

নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটি দেখতে ক্লিক করুন

ট্যাগঃ , , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।