Mahfuzur Rahman Manik
'নিউ নরমাল' ভুবনে 'প্রমোশন' ভ্রান্তি?
অক্টোবর 14, 2020
দেশে করোনায় সীমিত পর্যায় থেকে ধীরে ধীরে সর্বত্র অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে।

উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় 'অটো পাসে'র পর সরকার অন্যান্য ক্ষেত্রেও বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে 'প্রমোশনে'র চিন্তা করছে বলে সংবাদমাধ্যমের তরফে আমরা জানছি। অবশ্য পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত কাঙ্ক্ষিতই ছিল। আগস্টের শেষ সপ্তাহে সিদ্ধান্ত হয়- এ দুটি 'পাবলিক' পরীক্ষার বদলে শিক্ষার্থীরা স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। এখন সেই বার্ষিক পরীক্ষাই যদি না হয়, তবে তাদের মূল্যায়ন হবে কীভাবে?

করোনা পরিস্থিতি আমাদের অজানা নয়। এ দুর্যোগের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ রয়েছে। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত সাধারণ ছুটিতে দেশে লকডাউনের মতো পরিস্থিতি ছিল। এরপর সীমিত পর্যায় থেকে ধীরে ধীরে সর্বত্র অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি দফায় দফায় বাড়িয়ে সর্বশেষ ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। যদিও করোনা সে অর্থে নিয়ন্ত্রণে আসেনি, তার পরও 'নিউ নরমাল' তথা নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সবই যখন চলছে, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ থাকছে- এ প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে আমরা দেখেছি, অনেক দেশেই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে।

আমরাও দেখেছিলাম, জুলাইয়ের পর থেকে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে নানা প্রস্তাবনা ছিল। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া, যেমন- এক দিন বাদে এক দিন ক্লাস। কিংবা সকাল-বিকেল আলাদা শিফট ইত্যাদি। কিন্তু জুলাইয়ের পর আগস্ট গেল, সেপ্টেম্বর গেল, অক্টোবরও যখন ছুটির তালিকায় ফেলে দেওয়া হলো- তখন আর বুঝতে বাকি নেই আসলে প্রশাসন কোন পথ হাঁটছে।

সব যখন 'স্বাভাবিক', তখন শিক্ষায় কেন পরীক্ষা ছাড়া 'প্রমোশনে'র চিন্তা আসছে! শিক্ষা প্রশাসন উদ্যমী হলে কি অক্টোবরের শুরু থেকেই সীমিত পর্যায়ে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা যেত না? অন্তত এ সময় উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষাটি নেওয়া অসম্ভব হতো না। গুরুত্বপূর্ণ এ পরীক্ষা না হওয়ায় কেবল উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, একই সঙ্গে আমাদের শিক্ষাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব দেশ ভালো করছে, তারা মূল্যায়ন ছাড়া কোনো শিক্ষার্থীকেই পরবর্তী স্তরে ওঠার অনুমতি দিচ্ছে না। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন খুলেছে, একই সঙ্গে অনলাইন শিক্ষাও অব্যাহত রাখছে। যাতে কেউ বিদ্যালয়ে না এলেও যেন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে না থাকে।

শিক্ষার নীতিনির্ধারকরা যদি ভেবে থাকেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললে শিক্ষার্থীরা বুঝি বাড়িতে অবস্থান করবে। সেটি ভুল ভাবনা। আসলে শিক্ষার্থী তো বাড়িতে বসে নেই। কেউ কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, তা নয়; কিন্তু অধিকাংশই স্বাভাবিক অবস্থার মতো বাইরে বের হচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করছে। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে দিব্যি যাচ্ছে। শহরে যা-ও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, গ্রামে তার বালাই নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে বরং শিক্ষার্থীরা আরেকটু সচেতন হতো; তারা নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করত; সঙ্গে পড়াশোনাও চালু থাকত। আমার ব্যক্তিগত মত, প্রশাসন চাইলে সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করতে পারত। কারণ, তারা স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য যথেষ্ট পরিপকস্ফ। এর পর থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা নিয়ে অক্টোবর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সব স্তরে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমও শুরু করা যেত। আমরা সবক্ষেত্রে যদি 'নিউ নরমালে' অভ্যস্ত হতে পারি, তবে শিক্ষাক্ষেত্রে কেন এ চ্যালেঞ্জ নেব না? প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে অন্তত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা যেত। আমরা জানি, অনেক দেশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে খারাপ পরিস্থিতি দেখে আবার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। খুললে সে পথও তো আমরা অবলম্বন করতে পারতাম। আমরা দেখেছি, এর মধ্যেই মাধ্যমিক পর্যায়ের ফল ঘোষণা হয়ে কলেজ পর্যায়ে ভর্তি কার্যক্রম সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। এমনকি ১ অক্টোবর থেকে ইংরেজি মাধ্যমের এ-লেভেল এবং ও-লেভেলের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমতিও দিয়েছে।

করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় যারা দূরশিক্ষণে অংশ নিতে পারেনি তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলায় সবাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এরই মধ্যে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বেসরকারি নামিদামি প্রতিষ্ঠানও অনলাইনে নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম সম্পন্ন করছে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনলাইন কার্যক্রম, টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে পাঠ চলছে বটে। কিন্তু তা থেকে কেবল সেসব শিক্ষার্থীই উপকৃত হচ্ছে- যেসব পরিবারের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন কিংবা রেডিও-টিভি রয়েছে। বাকি অন্তত ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী, যাদের এসব সরঞ্জাম নেই, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের অধিকাংশই গ্রামে বাস করে। এদের জন্য অনলাইন কিংবা দূরশিক্ষণ শিক্ষা কার্যক্রম একটা বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের কথা ভেবে অন্তত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা জরুরি ছিল।

তবে সময় এখনও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। ৩১ অক্টোবরের পর আর ছুটি না বাড়িয়ে নভেম্বরের শুরুর দিন থেকেই শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করার ব্যাপারে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাই প্রস্তুতির জন্য দুই সপ্তাহ একেবারে কম হবে না। মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা তথা স্বাস্থ্যবিধি মানা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ সাধারণ সতর্কতা বজায় রাখার দিকে যেমন দৃষ্টি দেওয়া চাই, তেমনি চিন্তা করতে হবে সিলেবাস ও পরীক্ষা নিয়ে। আমরা দেখেছি, শিক্ষা বোর্ডগুলো বলেছিল, তারা দুই সপ্তাহের প্রস্তুতি নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারে। সরকার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করলে সীমিত আকারে সে পরীক্ষা নিতে পারে। অন্যদেরও পরবর্তী শ্রেণিতে পরীক্ষা দিয়েই উত্তরণের ব্যবস্থা করা উচিত। সে ক্ষেত্রে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে সরকার চলতি শিক্ষাবর্ষ আগামী মার্চ পর্যন্ত বাড়ানোর যে চিন্তা করেছিল, সেটিই বাস্তবায়ন হোক। শিক্ষাবর্ষের ছুটি কমিয়ে বয়স ও শ্রেণি অনুযায়ী শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি দেখে পরবর্তী শ্রেণিতে ওঠার জন্য যতটুকু না পড়ালেই নয়, তা শেষ করা উচিত। সংক্ষিপ্ত পরিসরে পরীক্ষা বা অন্য কোনো মূল্যায়নের মাধ্যমেই শিক্ষার্থী যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। করোনায় 'নিউ নরমাল' যখন সবক্ষেত্রে, শিক্ষায় কেন নয়।

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।