Mahfuzur Rahman Manik
প্রকল্প ও দিবসনির্ভর সাক্ষরতা
সেপ্টেম্বর 9, 2020

করোনাদুর্যোগের মধ্যেই এবারের সাক্ষরতা দিবসের তাৎপর্য বহুমুখী। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোও বিষয়টি ধরে দিবসটির প্রতিপাদ্য করেছে- 'কভিড-১৯ সংকট :সাক্ষরতা শিক্ষায় পরিবর্তনশীল শিখন-শেখানো কৌশল এবং শিক্ষাবিদদের ভূমিকা'। অর্থাৎ করোনার নতুন পরিস্থিতিতে সাক্ষরতা শিক্ষায়ও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখবেন শিক্ষক বা শিক্ষাবিদরা। বলাবাহুল্য, দেশে সাক্ষরতার যতটুকু অর্জন, সেখানে শিক্ষকরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে এসেছেন। আর সাক্ষরতার হার বাড়াতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবদানই বেশি। রোববার সাক্ষরতা দিবসের সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪.৭ শতাংশ। গত এক বছরে সাক্ষরতার হার বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। সাক্ষরতার হার নিয়ে বেসরকারি তথ্যে অমিল থাকলেও সরকারি হিসাব অনুযায়ীই চার ভাগের এক ভাগ মানুষ এখনও নিরক্ষর।

অথচ সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এরপর অর্ধযুগ পার হলেও আমরা শতভাগের কাছে যেতে পরিনি। এখানে ব্যর্থতা প্রকল্পের। সাক্ষরতা সংক্রান্ত দুটি বড় প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হলেও সেগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন হয়নি বলেই আমরা পিছিয়ে পড়েছি। অবশ্য সাক্ষরতার যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সেগুলোর ফলও সন্তোষজনক নয়। ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষকে সাক্ষর করতে ২০১৪ সালে ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া চলমান 'মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্পের (৬৪ জেলা)' ফলও হতাশাজনক। ৩ সেপ্টেম্বর সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসেছে, চার বছরের এই প্রকল্প দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ছয় বছর করলেও সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে বিশেষ কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি বলে সংসদীয় কমিটি ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ একে 'ব্যর্থ' প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংসদীয় কমিটি প্রকল্পটির মেয়াদ আর না বাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন নেওয়ার পরামর্শ দিলেও মুজিববর্ষের কথা বলে প্রকল্পের মেয়াদ তৃতীয় দফায় ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। দেখার বিষয়, এই প্রকল্প আর কতদূর যায়।

সাক্ষরতা প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হলেও সাক্ষরতার হার কিংবা এ নিয়ে প্রকল্পের তথ্য- কেবল দিবসটি এলেই কেন সামনে আসবে? সাক্ষরতাকে প্রকল্প আর দিবসের মধ্যে আবদ্ধ করার বহুবিধ ফল আমরা দেখছি। এতবড় একটি প্রকল্প চলমান থাকার পরও সাক্ষরতার হার এক বছরে মাত্র শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া বিস্ময়কর। নিরক্ষররা চোখ থাকতেও এক প্রকার অন্ধ। একজন দৃষ্টিহীনের এ সুন্দর পৃথিবী দেখার আকুতি অনুধাবন করা কঠিন নয়। যে নিরক্ষর তার বেদনা দৃষ্টিহীনের চেয়ে কম কীসে? যার আলো আছে, অন্ধকার দূরীভূত করার দায়িত্ব তারই। দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন শিক্ষার আলোয় আলোকিত, তখন একটি অংশের অন্ধকারের দায় আমরা কেউই এড়াতে পারি না।

সাক্ষরতার বিষয়টিকে কেবল প্রকল্প কিংবা দিবসকেন্দ্রিক না করে নিরক্ষর মানুষদের শিক্ষার আলোয় আনতে নিয়মিত কার্যক্রম থাকা চাই। শতভাগ মানুষ লিখতে, পড়তে, গণনা ও যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হলে তা কেবল ব্যক্তির জীবনকেই আলোকিত করবে না বরং দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। দেশের সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনা করছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো (বিএনএফই)। যেখানে একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। তাদের কাজ ওয়েবসাইটে নিয়মিত দেখতে চাই। আমরা দেখেছি, মাঠ পর্যায়ে সাক্ষরতা প্রকল্পগুলো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। বিএনএফইর দক্ষতা ও মনিটরিংয়ের অভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঠিকভাবে সাক্ষরতার কাজ হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। এনজিওনির্ভরতা কমাতে ও সাক্ষরতা কার্যক্রমে গতি আনতে বিএনএফইর উপজেলা পর্যায়ে প্রায় দেড় হাজার পদ সৃষ্টির কথা রয়েছে। সেটিও ভাবা যেতে পারে।

এখনও যারা নিরক্ষর, প্রথমে তাদের চিহ্নিত করে দেশব্যাপী স্বল্পমেয়াদি একটি কার্যক্রম নেওয়া যায়। আমরা জানি, প্রায় প্রতিটি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠান ছুটির পর বা সন্ধ্যায় এলাকার নিরক্ষরদের সাক্ষরতা প্রদান করতে এক বা দুই মাসের বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। সংশ্নিষ্টরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে কিংবা শিক্ষকরা বাড়ি গিয়ে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন। এ জন্য শিক্ষকদের যেমন অতিরিক্ত সম্মানীর ব্যবস্থা করতে হবে, তেমনি প্রশিক্ষণার্থীদেরও প্রণোদনা দেওয়া উচিত। ১৫ থেকে এর বেশি বয়সীদের সাক্ষর করতে এ সময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ূয়াদেরও সম্পৃক্ত করা যায়। আমরা জানি, করোনাদুর্যোগের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এখন গ্রামে অবস্থান করছেন। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমতে থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে আগে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দিয়ে এলাকাভিত্তিক সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিরক্ষরদের শেখানোর কাজ করতে পারেন। তারা মৌলিক সাক্ষরতা প্রদান করবেন। নব্য সাক্ষরদের শিক্ষা অব্যাহত রাখতে বিএনএফই বই, পত্রিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে।

আমাদের সাক্ষরতা অর্জনের শক্তির জায়গা হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ হওয়ায় কম শিশুই স্কুলের বাইরে থাকছে। সব শিশু অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও তার মৌলিক সাক্ষরতা অর্জন হয়ে যায়। কিন্তু করোনার কারণে এই অর্জন হুমকিতে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে সব শিক্ষার্থী শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেবে কিনা আমরা জানি না। করোনায় অনেক পরিবারই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে বেড়ে যেতে পারে। এ জন্য প্রণোদনাসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাবনাও রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে- করোনার কারণে কোনো শিশু যেন ঝরে না পড়ে। এ জন্য এবারের সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য আমলে নিয়ে সাক্ষরতা শিক্ষায় পরিবর্তনশীল শিখন-শেখানো কৌশল গ্রহণ করা চাই। এতে শিক্ষকদের ভূমিকা হতে পারে খোলার পর কোনো শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে না এলে বাড়ি গিয়ে তার খোঁজ নেওয়া। তাকে বিদ্যালয়ে আনার ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনে অভিভাবকের আর্থিক সহায়তার জন্য সুপারিশ করা। দারিদ্র্য, অনগ্রসরতা, শিশুশ্রম ও ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতার কারণে শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে থাকতে পারে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া চাই।

২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করার লক্ষ্যে নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়তে শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে আনা নিশ্চিত করাসহ প্রকল্প ও দিবসনির্ভরতার বিপরীতে নিয়মিত সাক্ষরতা কার্যক্রম গ্রহণ করতেই হবে।

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।