মূল : মং জারনি
গত সপ্তাহে লন্ডনে একত্রিত হয়েছিলেন জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ তথ্য-অনুসন্ধান মিশনের ক্রিস সিডটি, যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ও বাংলাদেশের একটি বিশেষজ্ঞ দল। ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে তারা আলোচনা করেন। এটা এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়, যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত রোহিঙ্গাদের আদিবাস সম্পর্কে 'মিথ্যাচারের' জন্য দায়ী করেন। যদিও বাংলাদেশ-মিয়ানমার গত বছরের অক্টোবরে প্রত্যাবাসনের একটি চুক্তি করে, কিন্তু জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হয়নি। প্রত্যাবাসনের জন্য সম্ভাব্য ৮০০ গ্রামের মধ্যে মাত্র দুটি গ্রামের পরিবেশ ইতিবাচক বলে জানা যায়।
আর সমস্যাটা এখানেই। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে এত বেশি রোহিঙ্গার উপস্থিতি সাধারণ কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শরণার্থী জনগোষ্ঠীকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালামের মত, চাহিদার (রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বার্ষিক পরিকল্পনা ৯২০ মিলিয়ন ডলার) মাত্র ২২ শতাংশ মিটেছে। মিয়ানমারের গণহত্যা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় ও খাবারের বন্দোবস্ত করা বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশের জন্য বোঝাস্বরূপ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত সাহায্য ছাড়া কেবল ঢাকার এ শরণার্থীর বোঝা বহন করা অন্যায্য।
অধিকন্তু, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থাকরণ প্রকারান্তরে মিয়ানমারের গণহত্যাকেই স্বীকৃতি দেবে। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল নে উইনের সময়কালে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পিত প্রচার শুরু করা হয়। এর পর তারা মিয়ানমারে রাখাইনের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে নৃশংস ও সন্ত্রাসী প্রচারণায় অংশ নেয়। নে উইন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেন। একই সঙ্গে মিয়ানমারের পরবর্তী শাসনগুলোতে সামরিক কিংবা বেসামরিক উভয় আমলে সবাই একই পথে হাঁটে। গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত নিপীড়নকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে।
যেসব অজুহাতে নির্যাতন-নিপীড়ন ন্যায্য করছে, তার অন্যতম পশ্চিম মিয়ানমারে 'মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি', 'জাতিগত দ্বন্দ্ব', 'সন্ত্রাসবাদের হুমকি' ইত্যাদি। যেমন ২০১৭ সালের অক্টোবরে অং সান সু চি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে উল্লেখ করেছেন যে, রোহিঙ্গা নিধন নয় বরং এটি তার সামরিক শরিক জেনারেল মিন অং হদ্মাং-এর 'সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স অপারেশনস' কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজ।
জাতীয়ভাবে বার্মার মানুষ মনে করে, সরকারের এই গণহত্যা আসলে রাখাইনকে একেবারে খাঁটি 'বৌদ্ধ' রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও এ অঞ্চলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাঙালিমুক্তকরণের পদক্ষেপ।
যে প্রশ্ন বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দ করেছেন এবং গত সপ্তাহের লন্ডন বৈঠকে উঠেছে, একটি প্রতিবেশী দেশ, যে কি-না প্রায় ৪০০ গ্রাম এক সপ্তাহে গুঁড়িয়ে দিতে পারে, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে নিজেদের দখলে নিতে পারে, এমন দেশটি কীভাবে গোটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন ভাগের প্রত্যাবাসনে ঢাকার সঙ্গে সহযোগিতা করবে?
এসব সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, দীর্ঘদিনের অধিকার ও নিরাপত্তাবঞ্চিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা এত সহজে আলোর মুখ দেখার কথা নয়। মিয়ানমার যেহেতু রোহিঙ্গাদের স্বার্থে কিছুই করেনি বরং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে তাদের নির্বাসনে পাঠিয়েছে, সেখানে প্রত্যবাসন নিয়ে যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব। কোনো রোহিঙ্গাই স্বেচ্ছায় মিয়ানমার যেতে চাইবে না। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থাকরণ, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান ও মৌলিক মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া প্রত্যাবাসন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এ অবস্থায় কৌশলগতভাবে ঢাকার অবস্থান কী হওয়া উচিত? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনটি প্রস্তাবের অন্যতম- মিয়ানমারের উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য 'সেফ জোন' তথা 'নিরাপদ এলাকা' প্রতিষ্ঠা। আমি এটার পক্ষে। চিন্তা করুন এমন একটি নিরাপদ এলাকা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে পারে, সেখানে তারা আন্তর্জাতিকভাবে সব দেশের সমন্বয়ে গঠিত সশস্ত্র কিংবা অস্ত্রহীন নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে থাকবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে এটি খুবই বাস্তবসম্মত প্রস্তাব। এটি ঢাকাকে জোর দিয়ে বলতে হবে। বলাবাহুল্য, মিয়ানমার হয়তো এ প্রস্তাব উগ্রভাবেই প্রত্যাখ্যান করবে। বার্মার কিছু কর্মকর্তা এরই মধ্যে সার্বভৌমত্বের ধুয়া তুলে সরাসরি তা প্রত্যাখ্যানও করেছেন।
এখন ঢাকার উচিত হবে একটি সম্ভাব্য অন্তর্বর্তী প্রস্তাব দেওয়া। সেটি হলো, গণহত্যার শিকার হয়ে কিংবা গণহত্যা এড়াতে যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য চাপ দেওয়া। এই দাবি হবে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের অন্যতম। যেখানে ঢাকা গণহত্যা প্রতিরোধের কনভেনশন অনুযায়ী ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসকে (আইসিজে) এই শাস্তির কথা বলতে পারে। ঢাকা এই আইনগত দাবি সম্মিলিতভাবে আইসিজে হয়ে কিংবা অন্য দেশের সঙ্গে করতে পারে। সেটা মালয়েশিয়াকে নিয়েও হতে পারে। কারণ দেশটি প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে।
বিকল্প হলো, গণহত্যার বিচার দাবি ও তার আইনি প্রতিকার চাওয়ার জন্য ঢাকার অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স-ওআইসির গাম্বিয়া নেতৃত্বাধীন উদ্যোগে অংশগ্রহণ করা। জাতিসংঘ এরই মধ্যে ২০১৮ সালে সামরিক বাহিনীর বিচারের বিষয়টির অনুমোদন দিয়েছে। এ মাসেই প্রসিকিউটর ফাটু বেনসৌদা আইসিজের বিচারকদের এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য বলেছেন।
আর বাংলাদেশ কেন এর একটা সমাধান পাবে না? যেখানে ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য দেশটিকে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে এ ক্ষতিপূরণ পেতেই হবে। ঢাকার উচিত প্রতি বছর এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে ওআইসি হয়ে আইসিজের মাধ্যমে চাপ দেওয়া।
অর্থনৈতিকভাবে এই চাপে ফেলার নীতিও হয়তো অন্য দেশগুলো জাতিগত নিধন ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে দেশত্যাগে বাধ্যকরণের মতো অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে। অন্য ১৫০টি সদস্য দেশ, যারা আইসিজের সদস্য তারা মিলেও জেনোসাইড কনভেনশনকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
১ জুলাই নেদারল্যান্ডসের আইনসভায় পাস হয়েছে, মিয়ানমার যে জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে, সেটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তোলার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদও এ বিষয়টি অনুসরণ করতে পারে। বিষয়টি সংসদে পাস করে সরকারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গেলে তার সুফল পেতে পারে।
সোজা কথা, মিয়ানমারকে অপরাধী রাষ্ট্র হিসেবে তার অপরাধের জন্য শাস্তিস্বরূপ অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
- তুরস্কের আনাদুলু এজেন্সি থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
- সমকালে প্রকাশিত, ১০ জুলাই ২০১৯
- ই-সমকাল হতে দেখুন
- লেখক : মানবাধিকার কর্মী; ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের বার্মিজ কো-অর্ডিনেটর;
- ছবি: অনলাইন