মূল : আশোক আলেকজান্ডার
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই সংগ্রাম করে আজ বিকাশমান। ভগ্ন আমলাতন্ত্র, ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থা, বেহাল স্বাস্থ্য খাত নিয়ে দেশটির যাত্রা শুরু। অথচ আজ গত কয়েক দশক ধরে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের উন্নয়নকে খ্যাতনামা চিকিৎসা সাময়িকী ল্যাঞ্চেট বলছে, 'বিশ্ব স্বাস্থ্যের এক অপার বিস্ময়।'
যদিও বাংলাদেশের জনপ্রতি জাতীয় আয় ভারতের অর্ধেকের চেয়েও কম। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয় জিডিপির ২.৮ শতাংশ আর ভারতে ব্যয় হয় ৪.৭ শতাংশ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের রেকর্ড একেবারে নিশ্ছিদ্র নয়, দেশটির গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিখুঁত করতে আরও করণীয় রয়েছে বটে। তারপরও বাংলাদেশ পাঁচ বছরের কম ও শিশু মৃত্যুহার, উর্বরতার হার ও গড় আয়ুর দিক থেকে ভারতের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে খোলা টয়লেট প্রায় শূন্য, যেখানে ভারতে এখনও ৪০ শতাংশ মানুষ খোলা জায়গায় প্রাকৃতিক কর্ম সারেন। এখন ভারতের একেবারে প্রতিবেশী একটি দেশ কীভাবে সফল হলো। তা থেকে ভারতেরই-বা কী শেখার আছে?
আসলে বাংলাদেশে এ অলৌকিক পরিবর্তন হয়েছে গত কয়েক বছরে। আমরা যদি এর কারণ খুঁজি তাহলে বলব, নারীরাই এ পরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। তারপরও কথা আছে, আসলে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নারীরাই এ পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিয়েছে। দেশটি তাৎপর্যপূর্ণভাবে নারীমুখী নীতিও প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। যেমন- মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা অবৈতনিক হয়েছে, মানবাধিকার সংরক্ষণ করেছে ও নারীদের কেন্দ্র করে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করেছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ভারতের চেয়ে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। নারী সাক্ষরতা ও নারীর ক্ষমতায়নের দিক থেকেও ভারতের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদ জ্যা দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, সব দিক ঠিক রেখে কীভাবে নারী সাক্ষরতা ও শ্রমশক্তি শিশুমৃত্যুর হার ও উর্বরতা বাড়িয়েছে।
লিঙ্গ সমতা অর্জনে বাংলাদেশের প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে ওপরের পদগুলোতে নারীদের বিস্তৃতির জন্যই। বেসরকারি সংগঠনগুলো, যেমন- ব্র্যাক দেশব্যাপী গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের কয়েক দশক ধরে ডায়রিয়ার সমাধান, টিকাদান পদ্ধতি ও গর্ভনিরোধের পদ্ধতি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এমনকি ব্র্যাক এমন পরিবেশ সৃষ্টিতে বিশ্বাস করে, যেখানে দরিদ্রতা দূরীকরণ হবে; একই সঙ্গে ভালো স্বাস্থ্যও নিশ্চিত করবে। যেসব নারী দরিদ্রতার শিকার, যারা পরিবারের ভরণপোষণেও ভূমিকা রাখেন, তাদের উচিত স্বাস্থ্যেরও তত্ত্বাবধায়ক হওয়া।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে নারীর ভূমিকা কীভাবে এত কার্যকর হলো। তার উত্তর আসলে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক। তবে অধিক প্রাসঙ্গিক বিষয় হলো, ভারত কি এ রকমটা পারবে? যদিও সেখানে নারীদের অবস্থান দুর্বল। আমার গণস্বাস্থ্যের অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের সাফল্য দেখে আমি খুব ভালোভাবেই বিশ্বাস করি যে, সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র নারীরাই উত্তরণ ঘটাতে পারে, বিশেষ করে যেখানে গণস্বাস্থ্য খাত ভঙ্গুর। ভারতে বিল গেটস ও মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের এইচআইভি রোধ প্রকল্প আভাহানে হাজারো অশিক্ষিত নারী ম্যানেজারের দায়িত্ব পালনসহ দেশব্যাপী সামাজিক কর্মসূচিগুলোতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। নারী তত্ত্বাবধায়ক ও তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা গোটা রাজস্থানজুড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শ্রমসাধ্য কাজ করছেন। এই কর্মসূচির প্রাথমিক পর্যায়ে রাজস্থানের কিশোরী মেয়েদের নিয়ে কাজ এটা প্রমাণ করছে যে, তারাই সমাজ পরিবর্তন ও ক্ষমতায়নে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। এটা সফলতার একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তাহলে কেরালায় স্বাস্থ্য খাতের অবিশ্বাস্য সফলতার গোড়ায়ও কি রয়েছে নারী? বলা বাহুল্য, সে আরেক কাহিনী।
ভারতের স্বাস্থ্য খাতের অস্বাস্থ্যকর চিত্রের মূলে রয়েছে অজুহাত ও সদিচ্ছার অভাব। দেশটির ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজুহাতে দেশটির স্বাস্থ্য খাতের দুর্দশা মেনে নেওয়ার মতো নয়। জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচি ও স্বাস্থ্য খাতের জন্য ব্যাপক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে রয়েছে বাস্তবতার অনেক ফারাক। আমাদের স্বল্পমেয়াদি চিন্তা ও পিরামিডের গোড়ায় তাকানোর মনোভাব পরিহার করতে হবে। তৃণমূলে স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে পুরুষদের নারীদের জন্য স্থান ছেড়ে দিতে হবে।
চিন্তা-চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন ও বাংলাদেশ থেকে কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে আমরা অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারি। সেটাই এখনকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- লাইভমিন্ট থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
- সমকালে প্রকাশিত, ২৭ এপ্রিল ২০১৮
- ই-সমকাল হতে দেখুন
- লেখক : ভারতের আনতারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক