Mahfuzur Rahman Manik
রোহিঙ্গা সংকট : বিশ্বের লজ্জাজনক নীরবতা
জানুয়ারী 18, 2018

মূল : মাইকেল শাম্মাস

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, ত্রাণের আশায়...

চার বছর আগে একদিন আরামদায়ক এক কফিশপে বসে সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে হাফিংটন পোস্টের জন্য লিখছিলাম। দুঃখজনকভাবে সে যুদ্ধ এখনও প্রাসঙ্গিক। কারণ, সিরিয়ায় মানুষ মারা যাচ্ছে। তাদের মৃত্যুর কারণ একটাই- ঘাতকরা তাদের চেয়েও শক্তিশালী। এত মানুষ মারা গেল, অথচ বিশ্ব কিছুই করল না। আমাদের দেশও (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) কিছু করল না। মুখোশ পরিহিত কিছু ব্যক্তি সিরিয়ার হাওলা ও ইদলিব নগরীর হোমস ও লাতাকিয়া ঘুরল; তারা স্বামীকে হত্যা করে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে সন্তানদের গণ্ডদেশে পিস্তল ধরে; একটু আগে যেখানে মা-বাবা আদরের পরশ বুলিয়েছিল। ঘটনাটি দেখল বিশ্ব। নির্দয়ভাবে শিশুটির মাথায় গুলি চালায়। আজও একই ঘটনা সেখানে ঘটছে। আমিও কফিশপে বসে নতুন লেখা লিখছি। কারণ আপনারা আমার লেখা পড়ছেন।

তখন এ রকম যে কোনো ঘটনা ঘটার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (২০১৩-১৭) জন কেরি অফিস ত্যাগের ঠিক আগে হত্যার কথা স্বীকার করে বলেন, সিরিয়ায় সরকারি ও বিরোধী উভয়েই গণহত্যা চালাচ্ছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানবতা সম্পর্কে এখন দুটি বিষয় সত্য- একটি হলো, মানবতা প্রায়শ নিষ্ঠুরতার পথ দেখায়। দ্বিতীয়টি হলো, আমাদের স্মৃতিশক্তি কম। কারণ, মিয়ানমারে সিরিয়া ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি দেখলাম আমরা, সংঘটিত হলো রোহিঙ্গা গণহত্যা। এক বর্বর শাসন কেবল মুসলিম বিশ্বাসের কারণে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বিশ্বের প্রতিক্রিয়া হয় কমই; বলা চলে এখন সবাই নীরব।

আন্তর্জাতিক বিশ্বের উদাসীনতার সুযোগে মিয়ানমার যেন বাশার আল আসাদের অমানবিকতাকে অনুসরণ করছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা চালিয়ে, তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে বৌদ্ধদের সহায়তায় হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। গোঁড়া বার্মিজরা বলছে, রোহিঙ্গা কেবল বার্মিজদেরই নয়, মানবতারও শত্রু। তারা কীটপতঙ্গের মতো। এদের মানবাধিকার রক্ষায় আমরা দায়বদ্ধ নই। বরং আমরা তাদের নির্মূল করি।

মিয়ানমারে গণহত্যায় আন্তর্জাতিক নীরবতা সিরিয়ার গণহত্যার আয়নায় দেখা যায়। কিছু ব্যর্থ সামরিক হস্তক্ষেপের পর আমরা থেমে গেছি। হস্তক্ষেপ যে সব সময় যথার্থ নয়. তা আমরা বুঝতে শিখিনি। সিরিয়া সমস্যার পূর্বে ইরাক ও আফগানিস্তানের দীর্ঘমেয়াদের সমস্যায় আমাদের বোঝা উচিত, হস্তক্ষেপ কখনোই ন্যায্য সমাধান হতে পারে না। যেমন গার্ডিয়ানের লেখক সাইমন টিসডল লিখেছেন- এমনকি অতি চরম পর্যায়েও এ ধরনের পদক্ষেপ কার্যকর নয়। নাইন-ইলেভেনের ধ্বংসযজ্ঞের পর মানবিক হস্তক্ষেপের আবেদন কমে গেছে। পরবর্তী সামরিক অভিযানের চিন্তা আমাদের অসুস্থতা ও বমন উদ্রেকের কারণ।

সিরিয়া ও মিয়ানমারের ঘটনায় আমাকে বিস্মিত করেছে মানুষের অমানবিক আচরণে। 'মানবতা'র কথা আমরা বলি; কিন্তু বাস্তবে দয়ার বিপরীতটাই আমরা দেখতে পাই। মিয়ানমারের বৌদ্ধ ও মুসলিমরা সিরিয়ার আলাওয়েটস, সুন্নি, ইয়াজেদি, খ্রিষ্টান সবাই কিন্তু মানুষ। এর মধ্যেই আমরা বিরোধ দেখছি। তবে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ আমাদের বিস্মিত করে।

যখন শক্তিশালী সরকার কোনো নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে হত্যা করে, তখন সে গোষ্ঠী বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। কারণ তাদের স্বীয় সরকার তাদের পরিত্যাগ করে। সরকারের সঙ্গে যেসব বিষয় কাউকে একীভূত করে, তখন সেগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন সরকার তাদের রক্ষকের পরিবর্তে ভক্ষকে পরিণত হয়। মিয়ানমারে যেটা হয়েছে, গত বছরের আগস্ট থেকে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। তাদের সরকার তাদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। এর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারও সরাসরি অপরাধী।

দুঃখজনক হলো, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিরোধ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে (রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) সেখানে নাক গলাতে সাহায্য করেছে। মিয়ানমারে কিংবা শক্তিহীন রোহিঙ্গা সে রকম ইস্যু নয় যে কেউ নাক গলাবে। তবে চীনের বিষয়টি বলা প্রয়োজন। জাতিসংঘ হয়তো আশঙ্কা করছে, নিরাপত্তা কাউন্সিলে কোনো প্রস্তাবে চীন তার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ভেটো দিতে পারে। যেমন রাশিয়া সিরিয়া ইস্যুতে বাশার আল আসাদের পক্ষে ভেটো দেয়।

কিন্তু রোহিঙ্গাদের কী হবে? এখন রোহিঙ্গারা একাকী ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। লজ্জা আমাদেরই।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।