Mahfuzur Rahman Manik
রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের দিল ও দরজা
অক্টোবর 5, 2017

মূল: মাইকেল হটজ

রোহিঙ্গাদের পাশে বাংলাদেশ

মিয়ানমার থেকে ছয় সপ্তাহ আগে যখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শুরু করে, তখন স্থানীয় হারুন রশিদ ও তার স্ত্রী তাদের সামর্থ্যানুযায়ী পানি, চাল, প্লাস্টিকের ত্রিপল দিচ্ছিলেন। কিন্তু এসব খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। অবশেষে গত সপ্তাহে একটি স্থানীয় ইসলামী দাতব্য সংগঠন সাময়িকভাবে তাদের বাড়িকে হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করে। তারা হাসিমুখেই তা মেনে নেয়। তাদের ঘর ব্যবহার হয় হাসপাতালের প্রসব ঘর হিসেবে। আর সম্মুখভাগ ব্যবহার হয় ফার্মেসি হিসেবে।
একদল স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক খুব দ্রুতই সেখানে পৌঁছে। তিন দিনে সেখানে পাঁচটি শিশু প্রসব করে। আর বাইরে হাজারো অসুস্থ ও আহত শরণার্থী ওষুধ গ্রহণ করে। রশিদ ও তার স্ত্রী বলছেন, তাদের বাড়িতে কোনো গভবর্তী এলে তিনি তাদের গ্রহণ করেন, তাদের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করেন। দু'জন চিকিৎসক তাদের ধরে ঘরে নিয়ে যান এবং প্রসবের ব্যবস্থা করেন। কেবল রশিদের পরিবারই নয়, এ রকম অনেকেই আজ সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য এগিয়ে এসেছেন। আগস্টের শেষ দিক থেকেই যখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, তখন থেকেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত পাঁচ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়, যা এশিয়ায় কয়েক দশকে সবচেয়ে ভয়াবহ শরণার্থী সংকট তৈরি করে।
বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বলছে, শরণার্থী আগমনের ধারা দুই সপ্তাহ ধরে কমেছে। যারা এসেছে তাদের চাহিদা মেটাতে মানবিক সংগঠনগুলো হিমশিম খাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য বিষয়ক সংস্থা ড্িব্নউএফপি আগামী ছয় মাসের জন্য ৭৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্য চেয়েছে। ড্িব্নউএফপির নির্বাহী পরিচালক বাংলাদেশের কয়েকটি শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে বলছেন, অবস্থা শোচনীয়।
এমনিতেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তার ওপর এ শরণার্থীর বোঝা সংকট নিশ্চয়ই আরও বাড়াবে। তারপরও বাংলাদেশ সরকার, জনগণ ও স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের জন্য যেভাবে এগিয়ে এসেছে, তা বিস্ট্ময়কর। পাশাপাশি জাতিসংঘ ও অন্যান্য বেসরকারি সংস্থাও শরণার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। শরণার্থী শিবির থেকে শত মাইল দূরের চট্টগ্রাম থেকে এক মৎস্যজীবী জসিম বলছেন, 'এখানকার সংকট আমি ফেসবুকে দেখে আসার সিদ্ধান্ত নিই।' তিনি শরণার্থীদের জন্য ১৫০০ টাকা নিয়ে এসেছেন। জসিম বলছেন, আমি জানি এ টাকা খুবই নগণ্য, তারপরও আমি কেবল আমার সামর্থ্য থেকে তাদের সাহায্য করতে চেয়েছি।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা এবারই প্রথম নয়। ৪০ বছর ধরেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের দ্বারা নানাভাবে সহিংসতার শিকার হয়ে আসছে। যখনই তাদের নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখনই রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। নিকটবর্তী প্রতিবেশী হিসেবে তারা বাংলাদেশকেই বেছে নেয়। এমনকি এ সংকটের আগেই বাংলাদেশের বালুখালী ও কুতুপালংয়ে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা কয়েক দশক ধরে বাস করে আসছে।
কিন্তু এবারের সহিংসতা সব মাত্রা ছাড়িয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা একে জাতিগত নিধনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া ছবিতে হিউম্যান রাউটস ওয়াচ দেখেছে, উত্তর রাখাইনে ২৮৪টির মতো গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে, গত ছয় সপ্তাহে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সহিংসতার সময় মিয়ানমারে ঠিক কত মানুষ মারা গেছে, সে হিসাব আমাদের কাছে নেই।
খন অবশ্য বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে আগুনের চিহ্ন দেখা যায় না। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকেও যেসব শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে তারা বলেছে, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অভিযান এখনও চলছে। এখনও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি অনেক সময় ঘরের ভেতর মানুষ রেখেই পোড়াচ্ছে তারা। গত সপ্তাহে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া ১৯ বছরের রোহিঙ্গা জানে আলমের সঙ্গে যখন আমি সাক্ষাৎ করি তখন সে জানায়, তারা বাবা-মাকেও সে ভাগ্যই বরণ করতে হয়েছে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জানে আলম আরও তিনজনের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছে। এখন সে খুশি, এখানে সে নিরাপদবোধ করছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থান এখন বাংলাদেশ। দশ লাখের অধিক রোহিঙ্গা এখানে আশ্রয় পেয়েছে। কেউ কেউ জীবনযাপনের উপায় হিসেবে এখানে দোকানও খুলছে। এটি বাংলাদেশের উদারতা ও এখানকার মানুষের খোলা হূদয়েরই প্রমাণ।

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।