Mahfuzur Rahman Manik
'উপমহাদেশীয় ট্র্যাজেডি'
সেপ্টেম্বর 10, 2017
এভাবে কোনো সন্তানের সঙ্গে আচরণ করা উচিত নয়

মা শিশুসন্তানকে পড়াচ্ছেন ওয়ান, টু, থ্রি...। মেয়ে বারবার ভুল করছে আর মায়ের হাতে মার খাচ্ছে। এমনি এক ভিডিও দেখে যে কারও ছোট্ট মেয়েটির জন্য মায়া লাগবে। আর মাকে মনে হবে অত্যাচারী। যে কি-না শিশুটির করুণ আর্তনাদ ও শাস্তি থেকে বাঁচার আবদার সত্ত্বেও তাকে রেহাই দিচ্ছে না, তার হুঙ্কার ও হাত সমানভাবেই চলছে। ভারতের এ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল, যা তারকা খেলোয়াড় বিরাট কোহলি, যুবরাজ সিংসহ অনেকেই শেয়ার করেছেন। তারা বলছেন, এভাবে কোনো সন্তানের সঙ্গে আচরণ করা উচিত নয়। ২৫ আগস্ট ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগে 'একেই বলে শিক্ষা দেওয়া_ নাকি শিক্ষা পাওয়া?' শিরোনামে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছাপা হয়। যার শুরুটা এ রকম_ 'তিন কি চার বছরের একটি মেয়ে ইংরেজি ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর আওড়াতে গিয়ে মায়ের কাছে বকা ও শেষ পর্যন্ত চড় খাচ্ছে। এক মিনিট ৯ সেকেন্ডের একটি খাঁটি উপমহাদেশীয় ট্র্যাজেডি।'
সত্যিই উপমহাদেশীয় ট্র্যাজেডি বটে। পড়াতে গিয়ে শিশুদের মারা আমাদের দেশে অনেক পরিবারেই সাধারণ ঘটনা। পরিবারের বাইরেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের মেরে পড়ানো স্বাভাবিক বিষয়। বহু বছর বেত, লাঠি ইত্যাদি এখানকার শিক্ষকদের শিক্ষার্থী 'শায়েস্তা' করার অন্যতম অস্ত্র ছিল। কখনও কখনও চড়-থাপ্পড়ের মাধ্যমে হাতও অস্ত্র। যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে আদালতের আদেশ রয়েছে, সরকারের নির্দেশনা রয়েছে; শিক্ষা আইনেও একে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপরও কিন্তু তা থেমে নেই। এমনকি অনেক সময় দেখা যায়, সাধারণ বিষয় নিয়েও কোনো কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করেন। সে খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়শই পাওয়া যায়। কয়েক বছর আগে ঢাকারই এক স্কুলে ক্লাসরুমে শিক্ষক ঢোকার পর শিক্ষার্থীরা সালাম দেয়। সালাম একটু লম্বা হওয়ার 'অপরাধে' শিক্ষক ৪-৫ জনকে বেধড়ক মারধর করেন। এতে এক ছাত্রের চোখের নিচের চামড়া ফেটে যায়, তাতে একাধিক সেলাই দিতে হয়। ২১ আগস্ট মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রীকে বেত্রাঘাত করে হাসপাতালে পাঠান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ছবি দেখে আমপাতা আঁকতে না পারাই শিশুটির অপরাধ। জরিপ বলছে, বাংলাদেশে ৮০ ভাগ শিশুই শারীরিক শাস্তির শিকার। ২০১৩ সালে ইউএনডিপির এক জরিপে দেখা যায়, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন জানিয়েছে যে, তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। তাছাড়া প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন শিশু জানায় যে, তারা বাড়িতে অভিভাবকদের হাতে শারীরিক শাস্তি পেয়ে থাকে। শারীরিক শাস্তির কারণে আমাদের দেশেই শিক্ষার্থী আত্মহত্য করার ঘটনাও ঘটছে।
এটা ঠিক, শিক্ষার্থীকে শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে নীতিমালা থাকার কারণে, শাস্তির খবর সংবাদমাধ্যমে আসার ফলে ও শিক্ষকের অনেক সময় দণ্ড হওয়ায়; সর্বোপরি মানুষের মাঝে সচেতনতার কারণে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। শ্রেণিকক্ষে বেত এখন গ্রহণযোগ্য নয়। তার পরিবর্তে শিশুদের আদর-ভালোবাসা দিয়ে পড়ানোর কথা বলছেন সবাই। এটাও ঠিক যে, শাসন বলে কথা আছে। তবে লাঠির দণ্ডের শাসন উল্টো ফল দিতে পারে।
পড়াতে গিয়ে মায়ের হাতে শিশুর মার খাওয়ার যে ভিডিওটি সামনে এসেছে, তা হয়তো ভারতের; কিন্তু তা আমাদের কথাও বলছে। শিশুশিক্ষায় উপমহাদেশের এ ট্র্যাজেডি বেদনাদায়ক। আমরা জানি, অনেক দেশেই শিশুদের ব্যাপারে কঠোর বিধান রয়েছে। এমনকি মা-বাবা শিশুকে মারলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমাদের এখানে সেটা নেই। তারপরও অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে_ এটাই আমাদের বিশ্বাস।

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।