Mahfuzur Rahman Manik
রোহিঙ্গা: ভয়াবহ শরণার্থী সমস্যা
সেপ্টেম্বর 24, 2017

মূল: দি ইকোনমিস্ট

রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ

রোহিঙ্গা মুসলমানদের এক জঙ্গি গ্রুপের ২৫ আগস্ট উত্তর মিয়ানমারের পুলিশ ক্যাম্পে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে অবাধ উন্মত্ততায় গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নিরপরাধ বেসামরিক মানুষ হত্যা করছে এবং নারীদের ধর্ষণ করছে। ৪ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি (১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) আতঙ্কিত রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যে গতিতে শরণার্থী বাংলাদেশে আসছে তার মাত্রা ও গতিকে অভূতপূর্ব বলছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। আর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার প্রধান জেইদ রাদ আর হুসাইন একে বলেছেন 'জাতিগত নিধনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ'।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ হত্যা ও নিপীড়নকে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি অস্বীকার করেছেন। মিয়ানমার সরকারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এ নেত্রী নারকীয় আক্রমণের নিন্দা করতেও উপর্যুপরি ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি ১৯ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত ভাষণে তিনি রোহিঙ্গা শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। উল্টো তিনি বড় গলায় দাবি করেছেন, ৫ সেপ্টেম্বরের পর কোনো ধরনের সহিংসতা কিংবা কোনো গ্রাম পোড়ানোর ঘটনা ঘটেনি। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সু চির ভাষণকে মিথ্যাচার হিসেবে আখ্যায়িত করে বালিতে মাথা গুঁজে রাখার কথা বলেছে। অ্যামনেস্টি বলছে, ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে যদি রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধ হয়ে যাওয়ার বক্তব্য সত্য হয়, তাহলে গত দু'সপ্তাহে আমরা সেখানে যেসব গ্রাম পুড়ে যেতে দেখেছি, সেগুলোতে কারা আগুন দিয়েছে? বলাবাহুল্য, ১৫ সেপ্টেম্বর স্যাটেলাইট থেকে তোলা রাখাইন রাজ্যের অনেক ছবি বিশ্নেষণ করে অ্যামনেস্টি বলছে, সেখানে তিন সপ্তাহে ৮০টির বেশি স্থানে বিশাল এলাকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো এ কাজ করছে।
বৈশ্বিক ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও সু চি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সুরেই কথা বলেছেন। সরকারের পক্ষেই তিনি অবস্থান নিয়েছেন। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সেনা সরকার রোহিঙ্গাদের দেশটির ১৩০টি স্বীকৃত জাতিসত্তা থেকে বাদ দিয়ে তাদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে। এ সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন করে, তাদের প্রতি নির্যাতনও তীব্রতর হয়। এমনকি ১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতার হাত থেকে পালিয়ে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে।
কিন্তু এবারের ঘটনা ঘটে বিস্তৃতভাবে খুবই দ্রুতগতিতে। গড়ে প্রতি সপ্তাহে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসেছে। এখন অবশ্য আসার গতি কিছুটা শ্নথ হয়েছে। তবে প্রতিদিনই আসছে মানুষ। প্রাণ বাঁচাতে সেনা নির্যাতনের ভয়ে যে যেভাবে পারছে দলে দলে আসছে বাংলাদেশে। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ছাড়াই আসছে রোহিঙ্গা শিশু। বৃদ্ধ মা-বাবা সন্তানের কোলে আসছে। দাতা সংস্থাগুলো বলছে, তারা মানুষের এ স্রোত দেখে বিস্ট্মিত। শরণার্থীদের খাদ্য, পানীয় ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ হিমশিম খাচ্ছে। এ ধরনের অন্য ঘটনায় হয়তো শরণার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল কিন্তু তারা আসত ধীরে ধীরে, আরও বেশি সময় পর পর। অথচ মিয়ানমার থেকে এবার দ্রুত মানুষের জনস্রোত এসেছে।
শরণার্থী প্রবাহের সাপ্তাহিক পরিসংখ্যান সেভাবে নেই। তবে দি ইকোনমিস্ট কয়েকটি সংকটের তথ্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে নিয়েছে। সেখানে এক বছরে শরণার্থী প্রবাহের হিসাবকে ৫২ সপ্তাহ ধরে (যেখানে বার্ষিক পরিসংখ্যান রয়েছে, যেমন ইরাক ও সিরিয়ার ঘটনা) কিংবা মোট শরণার্থীর সংখ্যা ধরে তাদের সময়ানুযায়ী হিসাব করা হয়েছে (যেমন লাইবেরিয়া বা আফগানিস্তানের ঘটনা)।
এসব পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, মিয়ানমার থেকে আগত বর্তমান শরণার্থী প্রবাহ আরও বেশি, এমনকি এটি ১৯৯৪ সালে সংঘটিত রুয়ান্ডা গণহত্যা-পরবর্তী সময়ের চেয়ে বেশি। সে সময় প্রায় ২৩ লাখ মানুষ দেশ থেকে পালিয়ে যায়, সংখ্যাটি ছিল দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের চেয়েও বেশি। সে সময় অবশ্য কেবল তুতসিরাই পালিয়ে যায়নি (যারা ছিল পরিকল্পিত গণহত্যার শিকার, তাদের অধিকাংশই পালাতে ব্যর্থ হয়) বরং হুতুরাও (হত্যাকারী) ছিল। আমরা অনুমান করছি সে সময় রুয়ান্ডার শরণার্থীদের অধিকাংশই পালায় ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে। এ হিসাব ধরলে, গড়ে দেখা যাচ্ছে প্রতি সপ্তাহে ১ লাখ ১১ হাজার রুয়ান্ডার অধিবাসী দেশত্যাগ করেছে। গত দশকে অবশ্য সিরিয়ার সংকট ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। প্রায় ৫৫ লাখ মানুষ সিরিয়া ত্যাগ করেছে। তবে তাদের গড় প্রবাহ হিসাব করলে দেখা যায়, প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ ২০১৩ সালে প্রতি সপ্তাহে দেশত্যাগ করেছে। সেটি ছিল এক ভয়ানক বছর।
মিয়ানমারে বর্তমান সহিংসতা শুরুর আগে দশ লাখের মতো রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করত। বলা চলে, তার অর্ধেক গেছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। বাংলাদেশে অবশ্য আগে থেকেই চার লাখের মতো রোহিঙ্গা বাস করে আসছিল। এর বাইরে প্রায় সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস করে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। এক হিসাব দেখাচ্ছে, পাকিস্তানে ৩ লাখ ৫০ হাজার, সৌদি আরবে ২ লাখ, মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার, ভারতে ৪০ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১০ হাজার, থাইল্যান্ডে ৫ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় ১ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে।
সু চি অবশ্য বলছেন, কিছু শরণার্থীকে ফেরত আনার জন্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করতে তিনি প্রস্তুত। তিনি বলেন, 'যে কোনো সময়' বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। ঠিক কতজনকে মিয়ানমার ফেরত নেবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

 

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।