প্রায় ৮০ বছর, যুক্তরাজ্য এখনও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু এবং উভয়ের মিত্রতা অন্য কারও তুলনীয় নয়। আমাদের বিশেষ সম্পর্কের কারণ, আমরা যুদ্ধের ময়দানে পরস্পর রক্ত ঝরিয়েছি। আমাদের সম্পর্ক কাজের মাধ্যমে সুদৃঢ় হয়, ইউরোপের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও টেকসই এবং বিশ্বে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত আমরা তৈরি করেছি। যুদ্ধভস্ম থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে পৃথিবীর শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ যথাযথ ভূমিকা রাখছে সেগুলো :জাতিসংঘ, ন্যাটো, ব্রেটন উডস, দ্য মার্শাল প্ল্যান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তাদের প্রচেষ্টা গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও আইনের শাসনে ভূমিকা রেখেছে; সাত দশকেরও বেশি সময়ে ইউরোপের শান্তি ও সমৃদ্ধির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে।
'ইউরোপের সমাধিগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের হাজারো মানুষের আত্মা সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার নীরব সাক্ষী।'
আজ আমরা সন্ত্রাস, আগ্রাসন, মাইগ্রেশন ও অর্থনীতির ব্যাপারে পরীক্ষার সম্মুখীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যখন একে অন্যের ওপর নির্ভর করতে পারবে, আমাদের বিশেষ সম্পর্ক ও অংশীদারিত্ব যখন বজায় থাকবে, তখনই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব হবে। লন্ডন সফরের এই সময়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও আমি এসব চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমাদের লোকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে আমরা অটল ও অবিচল থাকব।
ইসলামিক স্টেট ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত আমরা পদক্ষেপে কোনো কমতি করব না। ইয়েমেন থেকে সিরিয়া, সিরিয়া থেকে লিবিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার জন্য তাদের রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসায় আমরা কাজ করব। আমরা ন্যাটোতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখব। যাতে করে আফগানিস্তান থেকে এজিয়ান সাগরের দেশগুলোকে দেওয়া আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে। আমাদের মিত্র যারা রাশিয়ার আগ্রাসনের ব্যাপারে সোচ্চার তাদের আশ্বস্ত করার জন্যও এটা দরকার। আমরা অবশ্যই বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে প্রমোট করা অব্যাহত রাখব, যাতে করে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী আরও বৃহৎ সুযোগ ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে।
আমি এটা উপলব্ধি করতে পারছি যে, আমার এই সফরের সময় নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা ও বিতর্ক হচ্ছে। এটা স্বীকার করেই বলি, আমি আসলে মহামান্য রানীর জন্মদিন উপলক্ষে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে চাই। যদিও আমি জানি, এখানে কিছু ক্যাম্পেইন চলছে। আমার দেশেও এ রকমটা হচ্ছে। চূড়ান্ত বিচারে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অংশ হিসেবে থাকছে কি থাকছে না, তা ব্রিটিশ ভোটারদের দেখার বিষয়।
আবার রুজভেল্টে ফিরি। যখন তিনি আমাদের বিশেষ সম্পর্কের কথা বলছিলেন সে রাতে তিনি এও বলেছিলেন, আমরা পরস্পরের বন্ধু এবং একে অপরের দিক থেকে আমাদের কোনো ভয় নেই। তাই আমি বলব, আমাদের বন্ধুত্বের খাতিরে আপনাদের সিদ্ধান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আগেও বলেছি, ইউরোপের সমাধিগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের হাজারো মানুষের আত্মা সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার নীরব সাক্ষী। ফলে আপনার যে পথই বেছে নেন সেটা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রজন্মেরও প্রতিধ্বনি।
যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা ইইউর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত বলে আপনাদের গর্বিত হওয়ার বিষয় যে, ইইউ ব্রিটিশ নৈতিকতা ও অনুশীলনের প্রচারে বরং সাহায্য করছে। বিশেষত এই অঞ্চল ও সীমানার মধ্যে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মুক্তবাজার অর্থনীতি সম্প্রচার হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্রিটেনের প্রভাবকে পরিমিত করে না বরং বিকশিত করে। একটা শক্তিশালী ইউরোপ ব্রিটেনের নেতৃত্বের জন্য হুমকি নয়। বরং এটা ব্রিটেনের বৈশ্বিক নেতৃত্ব আরও ত্বরান্বিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখছে, কীভাবে ইউরোপে যুক্তরাজ্যের শক্তিশালী আওয়াজ বিশ্বে তার অবস্থানকে সংহত করছে এবং আটলান্টিকের অপর পাড়ের মিত্রদের সংযুক্ত করছে। তাই আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ব্রিটেনের এই শক্তিশালী অবস্থান প্রয়োজন।
আজকের জটিল ও সংযুক্ত বিশ্ব ব্যবস্থায় ইইউ মাইগ্রেশন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সন্ত্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যায় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। যে সমস্যাগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অপরাপর দেশও মোকাবেলা করছে, সেখানে আজ সবার ভূমিকা প্রয়োজন।
যখন আমরা ইরানে পরমাণু কর্মসূচির পরীক্ষা বন্ধে এক ঐতিহাসিক চুক্তি করেছিলাম, সেটা ছিল সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র, জার্মানি তথা আমাদের সবার প্রচেষ্টায় সেটা সম্ভব হয়েছিল। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আসনে যুক্তরাজ্যের কণ্ঠস্বর বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করেছিল।
প্যারিসে যখন জলবায়ু চুক্তির ব্যাপারে একটু ধাক্কার প্রয়োজন ছিল, তখন সেটা দিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যেখানে আসলে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা অনন্য। অবশেষে চুক্তিটি করতে আমরা সমর্থ হই।
যখন চাকরি, ব্যবসা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন পড়ছিল, তখন ইইউতে ব্রিটেনের বাজারের মাধ্যমে ব্রিটিশরাই বেশি উপকৃত হয়। একুশ শতকের অর্থনীতিতে ইইউর সঙ্গে ট্রান্স আটলান্টিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এক বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।
গোয়েন্দাবৃত্তি হতে শুরু করে সন্ত্রাস মোকাবেলা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি- এ ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতা ইউরোপের মধ্যে এক বিশেষ গতি আনবে। এখন প্রয়োজন কেবল বন্ধু ও মিত্রদের মধ্যে সম্পর্ক ও একত্রে লেগে থাকা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন একত্রে ইউরোপের শতাব্দীর পর শতাব্দীর যুদ্ধ পরিস্থিতিকে কয়েক দশকে শান্তিতে রূপান্তরিত করেছে এবং আমরা একত্রে একটি নিরাপদ ও সুন্দর বিশ্ব উপহারে কাজ করেছি। এটা কতই না উত্তম উত্তরাধিকার। এটাই আমরা রেখে যেতে চাই। যাতে এই নতুন শতাব্দীতেও সব সমস্যার মোকাবেলায় শান্তি ও সমৃদ্ধি অটুট থাকে।
- দ্য টেলিগ্রাফ থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
- সমকালে প্রকাশিত, ২৩ এপ্রিল ২০১৬
- ই-সমকাল হতে দেখুন
- বারাক ওবামা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট
- ছবি: অনলাইন