Mahfuzur Rahman Manik
এইচএসসির ফলে 'বিপর্যয়' নাকি ছন্দপতন
আগস্ট 22, 2013

HSC এবারের এইচএসসির ফলে কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ল। ৩ আগস্ট প্রকাশিত এ ফলকে সরকার দেখছে ‘বিপর্যয়’ হিসেবে। আর সংবাদ মাধ্যমগুলোও মোটাদাগে খারাপ হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। একে বিপর্যয় কিংবা খারাপ হিসেবে দেখার সুযোগ আছে কি?
১০টি শিক্ষা বোর্ডে এ বছর পাসের হার ৭৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর সর্বোচ্চ স্কোর জিপিএ ৫ পেয়েছেন ৫৮ হাজার ১৯৭ জন। যে কোনো পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে এ ফল মোটেও খারাপ নয়। বিপর্যয় তো নয়ই। বলা যায়, ধারাবাহিকতায় কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এইচএসসির ফলে যে ধারা চলে আসছিল তাতে কিছুটা ছেদ পড়েছে। যেখানে ২০১২ সালে পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ২০১১ সালে ৭৫ দশমিক ০৮ শতাংশ আর ২০১০ সালে ৭১ দশমিক ৮২ শতাংশ। জিপিএ ৫-এর ক্ষেত্রেও একই কথা। এ বছরগুলোতে জিপিএ ৫ ধারী ছিল যথাক্রমে ৬১ হাজার ১৬২, ৩৯ হাজার ৭৬৯ ও ২৫ হাজার ৫১২।
কোনো পরীক্ষায় উল্লেযোগ্য সংখ্যক পরীক্ষার্থী পাস করলে আর সর্বোচ্চ গ্রেডধারী তার অনুপাতে যথেষ্ট হলেই তা ভালো ফল। সে হিসেবে এবারের ফল ভালোই বলা যায়। প্রতি বছর এক রকম ফল হবে কিংবা পরবর্তী বছর আর ভালো হবে- এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এ প্রত্যাশা থাকতেই পারে যে, প্রতি বছরের ফল আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। পাসের হার ও জিপিও ৫ সর্বোচ্চ হবে। এটা যদি প্রত্যাশার বাইরে অন্য কিছু হয় কিংবা কর্তৃপক্ষও জোর করে ভালো করতে চায়, তা ভয়ংকর। তখন এ সন্দেহ পোষণ করা অমূলক হবে না যে, নিজ হাতেই আমরা পাসের হার বাড়াচ্ছি। বাড়াচ্ছি জিপিএ ৫। তখন আর ফল স্বাভাবিক থাকবে না। পাসের হার কিংবা জিপিএ ৫ ধারীর সংখ্যা বছর বছর ওঠানামা করতেই পারে। ‘এ’ লেভেলসহ আন্তর্জাতিক মানের সব পরীক্ষায় তা দেখা যায়। যেমনটা এবারের ফলে দেখা গেল। এটা স্বাভাবিক ফল।
তারপরও নানা কারণে ছেদ পড়েছে। এর মধ্যে হরতাল অন্যতম। যাকে দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী। হরতালের কারণে ৩২টি পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর পড়া স্বাভাবিক। তবে এত হরতাল ডাকার পরও এবারের এসএসসির ফল ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এইচএসসির ফলে ছেদ পড়ার আরও কিছু বাস্তব কারণ সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এসেছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর ভালো করে। এ বছর তারা খারাপ করেছে। বিশেষ করে রসায়নে খারাপ হয়েছে। নতুন করে এ বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ায় এটা হয়েছে। মানবিকের শিক্ষার্থীরাও তুলনামহৃলক খারাপ করেছে। বাংলা ও ইংরেজি প্রশেু তারা তেমন একটা ভালো করেনি।
হরতালের বাইরে বড় কারণ হিসেবে সৃজনশীল পদ্ধতি দেখা যাচ্ছে। সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যা পরিহার করে বুঝে উত্তর করে। যেখানে শিক্ষার্থীর মেধার সব বিষয় যাচাই করা হয়। এ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজে আনন্দের সঙ্গে বিষয়টি বুঝবে। এতে ফল আরও ভালো হওয়ার কথা। গত বছর যেমন ভালো হয়েছে। এবার সেখানে উল্টাটা ঘটল। কারণ হলো নতুন বিষয় অল্প দিনের নোটিশে সৃজনশীল করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা আগ থেকে প্রশু সম্পর্কে তেমন ধারণা পায়নি। আবার অনেক বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো বোঝেনি, অনেক শিক্ষকও বোঝেননি। শিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এমনকি যে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলো নোট-গাইডের বিদায়ঘণ্টা বাজানোর জন্য, সে পদ্ধতি অনেকে শিখছেন নোট-গাইড দেখেই! কারণ বাজারের নোট-গাইডও যে এখন সৃজনশীল হয়ে গেছে। ফলে শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশু তৈরি ও খাতা মূল্যায়নে ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক। এ জন্য অনেকে ধারণা করছেন, এ ঘাটতির ফলে তাদের উত্তরপত্র ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। তাই এবারের এইচএসসির ফল পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে মানববন্ধনও দেখা গেছে। যদিও প্রাসঙ্গিকভাবে আরেকটি বিষয়ের অবতারণা জরুরি, উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষকদের যে সময় দেওয়া হয় তা কম। তাদের অল্প সময়ে অনেক বেশি উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে হয়। আবার একই সঙ্গে নানা টেকনিক্যাল বিষয়েও খেয়াল রাখতে হয়। এভাবে সব দিক ঠিক রেখে অল্কপ্প সময়ে ন্যায্যভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন কতটা সম্ভব?
Plusপরীক্ষা বিষয়টাই পাস-ফেলের। তারপরও আমরা চাই সবাই পাস করুক। সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিতে হবে। তবে পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে ভালো কিংবা খারাপ হিসেবে দেখার আগে তার পেছনের অনুঘটকগুলো দেখা প্রয়োজন। খারাপ করলে কী কারণে শিক্ষার্থীরা খারাপ করেছে তা চিহিক্রত করা দরকার। ফলের ক্ষেত্রে পাসের হার আর জিপিএ ৫-এর সংখ্যাই আমরা গুণে আসছি। আমরা কেবল এ দুটি বিষয়ের পরিমাণ বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিচ্ছি, একই সঙ্গে গুণগত মান বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছি না। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রশাসন- সবাই ভালো জিপিএ চান। কে কত সহজে জিপিএ ৫ পেতে পারে সে প্রতিযোগিতাই দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। অনেকেই অভিযোগ করছেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দিন দিন গুণগত মান হারাচ্ছে। ভালো ফলের পাশাপাশি বাস্তবে শিক্ষার্থীরা কতটা শিখতে পারল সে বিষয়ে শ্রেণীকক্ষে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
অস্বীকার করার উপায় নেই, এইচএসসির জিপিএ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ফলই অনেকটা বলে দেয় বাস্তবে কে কতদূর যেতে পারবে। ভালো জিপিএ না থাকলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করারই সুযোগ থাকে না। এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যার তুলনায় পাস করা শিক্ষার্থী অনেক। বিশাল এ প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় যার যত ভালো জিপিএ থাকবে সে তত এগিয়ে থাকবে। আর জিপিএর ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি করালে তো কথাই নেই।
নানা সমস্যা, সংকট থাকা সত্ত্বেও শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য লক্ষণীয়। সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। হরতাল, রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা প্রয়োজন। এসবের প্রভাব যাতে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর না পড়ে এ বিষয়ে তাদের বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত। এছাড়া এবারের ফলে যে সৃজনশীলতার বিষয়টি এসেছে, সে বিষয়ে সংশ্লষ্টদের মনোযোগী হওয়া উচিত। সৃজনশীলতা শিক্ষার জন্য ভালো হলেও তা যদি ভালোভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বোঝানো না হয়, তো উল্টা ফলই ফলবে। সব ঠিক থাকলে আগামী বছর থেকেই এইচএসসিতে ফলের ধারাবাহিকতা অক্ষুণু থাকবে- এ আশা করা যেতেই পারে।

ট্যাগঃ , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।