মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই পরস্পরের আপন। তার জন্মসূত্রে কেউ মা, কেউ বাবা এভাবে কেউ ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী। তারা আপনজন, আত্মীয়স্বজন। তাদের কারও কিছু হলে অন্যজনের ওপর তার প্রভাব পড়ে। এটাই চিরন্তন রীতি। কোথাও কেউ বিপদে পড়লে আত্মীয়স্বজনরাই প্রথম এগিয়ে আসেন। দুর্যোগে এগিয়ে আসেন পাড়া-প্রতিবেশী, সাধারণ মানুষও। সাভার ট্র্যাজেডিতে আমরা ব্যতিক্রম দেখিনি। এখানে রানা প্লাজা ধসের পর এ লেখা পর্যন্ত ৭৭ ঘণ্টারও বেশিসময় পার হয়ে গেছে। উদ্ধার তৎপরতা চলছে। মৃত লাশ যেমন বের হচ্ছে, তেমনি জীবিত মানুষও উদ্ধার হচ্ছে। মাঝখানে বৃষ্টিতে এতখানি ছেদ পড়েনি তাতে। সংবাদমাধ্যম লাশের সংখ্যাটি হিসাব করেছে ৩৪১। তৃতীয় দিনে রানা প্লাজার আশপাশে মানুষের সংখ্যা বোধহয় একটু বেশিই লক্ষ্য করা গেছে। উদ্ধারকর্মী, সংবাদমাধ্যমকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী, দর্শক ছাড়াও সেই স্বজনের ভিড় লক্ষণীয়। স্বজনের খোঁজে হাজারো মানুষ ছুটে এসেছেন। বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে তাদের। ধসেপড়া ভবনের পাশে আছেন বেশিরভাগ, আহত-নিহত যাদেরই উদ্ধার করা হচ্ছে দেখছেন আত্মীয় কি-না। না পেলে ছুটছেন হস্তান্তরের জন্য লাশ রাখা সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে না পেলে পাশের এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে, এরপর ছুটছেন অন্যান্য হাসপাতালে। সর্বশেষ ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজ।
কারও মা এসেছেন, কারও বাবা এসেছেন, ছেলে এসেছেন, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী এসেছেন। যাদের আহাজারি আমরা দেখেছি। কারও হাতে শোভা পাচ্ছে নিখোঁজ স্বজনের আইডি কার্ড, কারও হাতে ছবি_ এভাবে শনাক্তকরণের যত উপকরণ আছে সব নিয়ে হাজির হয়েছেন স্বজনরা।
একেকজনকে উদ্ধার করে আনার পর হুমড়ি খেয়ে পড়া স্বজনের দৃশ্য সত্যিই হৃদয়বিদারক। প্রত্যেকে তাদের প্রিয় মানুষটিকে পেতে চান। যদিও তারা জানেন না সে মানুষটি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন। যে অবস্থায়ই আছে তাকে পেতে চান। মারা গেলেও তার লাশটি স্বজনের কাছে অমূল্য। নিরাপদ মৃত্যুর সুযোগ না পেলেও অন্তত নিরাপদ দাফনের ব্যবস্থাপনা করার আকুতি তাদের।
এ রকম ঠিক কত স্বজন এসেছেন তার কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে এসেছেন তারা। পাবেন এ নিশ্চয়তা নিয়েই হয়তো এসেছেন। অনেকেই হয়তো আহত কিংবা নিহত স্বজনের লাশ পেয়েছেন। সংবাদমাধ্যমে দ্বিতীয় দিন থেকেই যেভাবে আমরা না পাওয়া স্বজনকে দেখেছি, যতজন উঁচিয়ে তার কাঙ্ক্ষিত স্বজনের ছবি দেখাচ্ছেন সবাই তো নিশ্চয়ই পাননি। পাননি এ রকম সংখ্যাও হয়তো একেবারে কম নয়। পেলে সেখানে এখনও এত ভিড় হওয়ার কথা নয়। তৃতীয় দিনের শেষ বেলায়ও যখন মানুষ বের হচ্ছে এরপরও কত মানুষ ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে তারও হিসাব নেই। যদিও একটি সংবাদমাধ্যম ৮৬৯ জন নিখোঁজ থাকার কথা বলেছে। তবে ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা রকর্মে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে_ এ ধরনের সংবাদ বেশি দেখা যাচ্ছে। তারপরও যদি একজন জীবিত মানুষও উদ্ধার করা যায় সেটাই সাফল্য।
ভালো বিষয় হলো, উদ্ধারকৃত লাশের অধিকাংশই আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা গেছে। তবে কয়েকটি লাশ হস্তান্তর করার জন্য স্বজন খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে অনেকে তিনদিন ধরে সাভারসহ এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়েও প্রিয় স্বজনকে পাননি। এরপরও আরেকজনের লাশ কেউ নেবে না, এটাই দুনিয়ার নিয়ম।
- সমকালে প্রকাশিত ২৮ এপ্রিল ২০১৩
- ছবি- সমকাল