Mahfuzur Rahman Manik
নিজস্ব আয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নীতি!
অক্টোবর 8, 2011

‘বাংলাদেশে বর্তমানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি ফি ও বেতন খুবই সামান্য।’ এ বক্তব্য দিয়ে শিক্ষাব্যয় বাড়ানোর একটা নীতিগত ন্যায্যতা তৈরি করেছে শিক্ষানীতি। অবশ্য এর আগের সব শিক্ষানীতি বা কমিশন— তা কুদরাত-এ খুদাই হোক, মজিদ খান কিংবা শামছুল হক সবাই এ শিক্ষাব্যয় বাড়ানোর সুপারিশই করেছেন
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় ভর্তির হারটা দেখার চেষ্টা করি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০০৬-এর হিসাব অনুযায়ী ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়, যা অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করা ছিল বাস্তবতা। ঘটল উল্টোটা। ২০০৬ সালে তৈরি হয় দেশের উচ্চশিক্ষা কৌশলপত্র, যেখানে শিক্ষার সম্প্রসারণের বদলে সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এ কৌশলপত্র অনুযায়ী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বৃদ্ধি করে।
সম্প্রতি (২৫ সেপ্টেম্বর) প্রথম আলো ‘তিন বিশ্ববিদ্যালয়কে টাকা দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় রাজি নয়’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় বলে দেয়া হয় পাঁচ বছর এবং জাতীয় কবি নজরুল ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে ১০ বছরের মাথায় নিজের আয় থেকে নিজস্ব ব্যয় নির্বাহ করতে। পাঁচ বছর পার হওয়ার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আর অন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ১০ বছরের মেয়াদ শেষের আগেই বলছে, এটা সম্ভব নয়।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের দিন থেকেই উত্তাল ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। অবশ্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অনেক দিনের। বিশেষ করে তারা যখন জানল, সরকার তাদের কাঙ্ক্ষিত ২৭(৪) ধারা বাতিলের দাবিকে অস্বীকার করে জানিয়ে দেয়— এ ধারা বাতিল হবে না। অর্থাত্ তাদের নিজস্ব আয়েই চলতে হবে এবং সরকার কোনো টাকা দিতে পারবে না। ২৫ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর চার দিনের বিক্ষোভ প্রশাসন সামলাতে না পেরে পূজার ছুটির নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ২৭(৪) ধারায় বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পৌনঃপুনিক ব্যয় জোগানে সরকার কর্তৃক প্রদেয় অর্থ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাইবে এবং পঞ্চম বত্সর হইতে উক্ত ব্যয়ের শত ভাগ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় ও উত্স হইতে বহন করিতে হইবে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি দমাতে পুলিশ যেমন তাদের ওপর দমন-পীড়ন করে, তার চেয়ে ছাত্রলীগের পদদলন ছিল দেখার মতো। এর চেয়েও আশ্চর্যের বিষয়— জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ব্লগাররা যখন সোচ্চার, সে আন্দোলন থেকে ৩১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় ব্লগার আসিফকে।
জগন্নাথের বিষয়ে বিস্তর আলোচনার পরিবর্তে আমাদের উচ্চশিক্ষার নীতি দেখব। কারণ জগন্নাথের এ ঘটনাপ্রবাহ এ নীতিরই এক অনিবার্য পরিণতি। ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির অর্থায়ন এবং পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র তৈরি করে। কৌশলপত্রের সুপারিশমালা চার পর্বভিত্তিক মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো— প্রাথমিক পর্ব ২০০৬-০৭, স্বল্পমেয়াদি ২০০৮-১৩, মধ্যমেয়াদি ২০১৪-১৯ ও দীর্ঘমেয়াদি ২০২০-২৬। এতে সরকারের কাছে উচ্চশিক্ষা খাতে সব ধরনের ভর্তুকি বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা ব্যয় খুবই কম। সরকারের উচিত উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীদের মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড তৈরি করা।
মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের ৫০ শতাংশ অর্থ আসতে হবে এর অভ্যন্তরীণ খাত থেকে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ খাতে আয় বাড়ানোর দিকটায় জোর দিতে হবে। মঞ্জুরি কমিশনের এ সুপারিশ এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাস্তবায়ন শুরু করেছে। সরাসরি বেতন-ফি বৃদ্ধি না করেও বিভিন্ন ফির নাম করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকই টাকা নিচ্ছে। যেমন বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন মাসে ২৫ টাকা। সে হিসাবে বছরে দাঁড়ায় ৩০০ টাকা। অথচ গত দুই সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুধু পরিবহন চার্জই দিতে হয়েছে বার্ষিক এক হাজার ৮৫ টাকা করে।
২০০৬ সাল থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্নভাবে বছর বছর ফি বাড়াচ্ছে। অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির কয়েকটি খাতের মধ্যে রয়েছে ছাত্র বেতন বৃদ্ধি, আবাসন ও ডাইনিং চার্জ বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা ভাড়া দেয়া, ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া, দোকান ভাড়া, কনসালটেন্সি সার্ভিস, বিশ্ববিদ্যালয়ের বীমা প্রভৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়ানোর আরেক নজির হলো সান্ধ্য কোর্স চালু।
জগন্নাথসহ সাম্প্রতিক সময়ে যত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সবগুলোর চরিত্রই বলা চলে ‘নামে পাবলিক হলেও কর্মকাণ্ডে প্রাইভেট’। বলা যায়, ‘বেসরকারি মডেলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়’। যেমন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ চারটি। ভর্তি ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার ২০০, ডাইনিং ফি এক হাজার ৮০০ এবং বিদ্যুত্ বিল ও সেমিস্টার ফি বাবদ ৫ হাজার টাকা দিতে হবে প্রতি শিক্ষার্থীকে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার নীতিতে সম্প্রসারণের চেয়ে সংকোচন প্রবণতা স্পষ্ট। আমাদের শিক্ষানীতিগুলোও নীতি হিসেবে সংকোচনকে গ্রহণ করেছে। অবশ্য এবারের চূড়ান্ত শিক্ষানীতিতে কৌশলে এ ধারাটি বাদ দেয়া হয়েছে, যদিও নীতির খসড়ায় তা স্পষ্ট ছিল। উচ্চশিক্ষা অধ্যায়ে কৌশল-১০ এ বলা হয়েছে, ‘সরকারি অনুদান ছাড়াও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যয় নির্বাহের জন্য শিক্ষার্থীর বেতন ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যক্তিগত অনুদান সংগ্রহের চেষ্টা চালাতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি ফি ও বেতন খুবই সামান্য।’ এ বক্তব্য দিয়ে শিক্ষাব্যয় বাড়ানোর একটা নীতিগত ন্যায্যতা তৈরি করেছে শিক্ষানীতি। অবশ্য এর আগের সব শিক্ষানীতি বা কমিশন— তা কুদরাত-এ খুদাই হোক, মজিদ খান কিংবা শামছুল হক সবাই এ শিক্ষাব্যয় বাড়ানোর সুপারিশই করেছেন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের পিআরএসপির কৌশলেও ছাত্রদের বেতন-ফি বাড়িয়ে শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ১৭ থেকে ২৩ বয়সী ৪ শতাংশের কিছু বেশিসংখ্যক ছাত্র উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। ভারতে এ হার ১১ দশমিক ৯, মালয়েশিয়ায় ২৯ দশমিক ৩ ও থাইল্যান্ডে ৩৭ দশমিক ৩ ভাগ। আমাদের উচ্চশিক্ষা সবার জন্য আবশ্যক, সে কথা বলছি না। দেশের বেশির ভাগ মানুষের অবস্থার আলোকে যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যভাবে বললে দেশের দরিদ্র কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে ভূমিকা পালন করছে, এ জায়গাটায় বিশ্ববিদ্যালয় যে থাকছে না তা স্পষ্ট। ‘টাকা যার শিক্ষা তার’ নীতির মাধ্যমে শিক্ষা হয়ে পড়ছে কেবল এক শ্রেণীর জন্য। এতে বঞ্চিত হচ্ছে দরিদ্র শিক্ষার্থী।
সরকার উচ্চশিক্ষার জন্য দাতাদের দেয়া প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করে আদৌ লাভবান হওয়ার মতো কোনো বিষয় স্পষ্ট নয়। এমনিতেই আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাল যাচ্ছে। তেমন কোনো গবেষণা নেই, জাতীয়ভাবেও তেমন অবদান রাখতে পারছে না। র্যাংকিংয়ে দিন দিনই পিছিয়ে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং নিয়ে গণমাধ্যম প্রায়ই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ৫ হাজারের মধ্যেও নেই এটি। এ অবস্থায় যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সরকারের গবেষণাসহ সার্বিক ব্যয় বাড়ানো উচিত, সেখানে তা সংকোচনের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার মতো নয়।
উচ্চশিক্ষায় সরকারের টাকা জোগাতে অনীহা স্পষ্ট। প্রত্যেক বছর বলা হয়, বাজেটে শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দেয়া হয়। মূলত তা শুভঙ্করের ফাঁকি। কারণ প্রত্যেক বছরই দেখা যায়, শিক্ষা খাতকে অন্য একটি খাতের সঙ্গে মিলিয়ে এতে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ দেয়া হয়। সর্বশেষ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। আবার এ অংশ জাতীয় আয়ের ২ শতাংশ মাত্র। ইউনেস্কোর নির্দেশনা হলো শিক্ষা খাতে ৮ শতাংশ ব্যয় করা।

বণিক বার্তা, উপসম্পাদকীয় ১০ অক্টোবর ২০১১

ট্যাগঃ

2 comments on “নিজস্ব আয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নীতি!”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।