Mahfuzur Rahman Manik
বেকার সমস্যা সমাধানে সরকারি প্রকল্প
মার্চ 18, 2010

ঢাবির একজন শিক্ষার্থীর অনুভূতি দিয়ে শুরু করা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের রিডিং রুমে পড়তে পড়তে টেবিলে লিখেছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, একটা ভালো চাকরি যদি না পাই এর চেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় আর কী হতে পারে”। হয়তো সে তার মনের এ বিষয়টি কারো সাথে শেয়ার করতে না পেরে টেবিলে লিখেছে। কিন্তু যে শিক্ষার্থী তীব্র প্রতিযোগিতার যুদ্ধে জয়ী হয়ে ভর্তি হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে, রিডিং রুমে এসে পড়াশোনা করছে, তার চাকরি না পাওয়ার এ আশংকা কেন? উত্তরটা অত্যন্ত স্পষ্ট- আমাদের দেশে চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। চাকরি এখানে সোনার হরিণ। চাইলেই কেউ কাক্সিক্ষত চাকরি করতে পারে না। এখানেই অর্থনীতিবিদ পিগুর কথা- ‘যখন কর্মক্ষম জনগণ তাদের যোগ্যতা অনুসারে প্রচলিত মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতে চায় অথচ কাজ পায় না সে অবস্থাকেই বলা হয় বেকারত্ব।’বাংলাদেশে এ বেকারত্ব বা বেকার সমস্যা কতটা প্রকট তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ষোল কোটি মানুষের দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা এখন তিন কোটি। এর মধ্যে ২০০৬-এর হিসাব অনুসারে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২১ লাখ। ২০১০-এ এসে সংখ্যাটা যে বাড়বে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রত্যেক বছর লক্ষাধিক শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বের হয়। এর বাইরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তো রয়েছেই, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা নাইবা বললাম। স্পষ্টতঃই দেখা যাচ্ছে দিন দিন বেকারের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।স্বাভাবিকভাবেই বেকার সমস্যা দেশের এক বিরাট সমস্যা। এটি সকলের মাথা ব্যথার অন্যতম কারণও বটে। এ মাথা ব্যথা উপশমে সরকার বা প্রশাসন কোনো ভূমিকা নিক বা না নিক, এটা কিন্তু নির্বাচনের অন্যতম ইস্যু। নির্বাচনের আগে সব দলই দৃঢ় পদক্ষেপের বুলি ছোড়ে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ও নির্বাচনী ইশতিহারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিলো বেকার সমস্যার সমাধান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি। ইশতিহারের ১৪ নং পয়েন্টে যুব সমাজ ও কর্মসংস্থান শিরোনামে সে কথাই বলা হয়েছে- ‘বছরে ন্যূনতম ১০০ দিনের কর্মসংস্থানের জন্য প্রত্যেক পরিবারের একজন কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীকে কর্মসংস্থানের জন্য এমপলয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম পর্যায়ক্রমে কার্যকরী করা হবে। সকল কর্মক্ষম নাগরিকের নিবন্ধন করা হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নতুন প্রজন্মের সমুদয় যুব সমাজকে দুই বছরের জন্য ন্যাশনাল সার্ভিস-এ নিযুক্ত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।”আওয়ামী লীগ তার এ নির্বাচনী ইশতিহারের অঙ্গীকার অনুযাযী পরোক্ষভাবে অনেক আগ থেকেই কাজ শুরু করেছে বলে গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা জেনেছি। প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থানের উদ্যোগটা দেখা যায় এ মাসের ছয় তারিখে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামে চারজন বেকার তরুণ-তরুণীর হাতে মননয়নপত্র তুলে দিয়ে প্রতিশ্রুত ‘ন্যাশনাল সার্ভিসের’ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ সার্ভিস জেলার ৯ হাজার ৯৫০ জনকে এ প্রকল্পের আওতায় আনে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়- ‘কুড়িগ্রাম মঙ্গা হতে দিব না, আর মঙ্গা হবে না। সবার পেটে ভাত থাকবে, মানুষ শান্তিতে ঘুমাবে। কুড়িগ্রামের পর বরগুনা হবে দ্বিতীয় জেলা যেখানে অচিরেই এ কমিশন এর কাজ শুরু হবে। বেকারত্ব ঘুচানোর জন্য এ প্রকল্প মূলত একটি প্রশিক্ষণ প্রকল্প। এখানে বেকারদের প্রশিক্ষণকালীন সময়ে দৈনিক ১০০ টাকা হারে দেয়া হবে। তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর পরবর্তীতে দুই বছর দৈনিক ২০০ টাকা হারে অর্থাৎ মাসে ছয় হাজার টাকা করে দেয়া হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ৭ লাখ ২০ হাজার বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে এ প্রকল্প।বেকারত্ব নিরসনে উদ্ভাবিত সরকারি এ প্রকল্পের কথা জাতীয় বাজেটে এসেছিলো। বেকারত্ব নিরসনে এ প্রকল্প যে যথেষ্ঠ নয় তা বলা যায়। একদিকে যেমন এটি স্থায়ী চাকরি নয়, অন্যদিকে এর স্থায়ীত্বও বেশি নয় এর সাথে বেতনের পরিমাণটা তো আছেই। এটি পানির পিপাসায় ভীষণ তৃষ্ণার্তকে এক চামচ পানি দিয়ে তার পিপাসার জ্বালা বাড়ানো নয়, বরং সে অল্প পানি তার কিঞ্চিত পিপাসা মেটানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হবে। অর্থাৎ আমাদের পাহাড়সম বেকারের কিছুটা পাথেয় হিসেবের এ প্রকল্প ভূমিকা রাখবে। কম্পিউটার, চরিত্রগঠন, শারীরিক শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির প্রশিক্ষণ অস্থায়ী হলেও, এ সময়টা কম হলে এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ একজন ব্যক্তিকে তার স্থায়ী বেকারত্ব ঘুচানোর কাজ করবে । প্রধানমন্ত্রী তো সে আশাবাদই ব্যক্ত করেছেন- ‘দুই বছর পর এসব বেকার যুবক ও যুব মহিলা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারবে এবং অপরকেও কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।প্রশিক্ষণের বিষয়ে বলার মতো বিষয় হলো প্রশিক্ষণগুলো হবে বাস্তব ভিত্তিক। এখানে অবশ্য কম্পিউটারের কথা এসেছে। বর্তমান প্রযুক্তির দুনিয়ায় কম্পিউটারে ইন্টারনেটসহ যে নানাবিধ বিষয় সেগুলো যেন নিশ্চিত হয়। এছাড়া এ প্রশিক্ষণগুলোর মাধ্যমে প্রার্থীরা যাতে দেশে এবং বিদেশে কর্মসংস্থান করে নিতে পারে সে বিষয়টির দিকে নজর দেয়া যেতে পারে।আওয়ামী লীগ প্রত্যেক পরিবারকে চাকরি দেয়ার যে অঙ্গীকার করেছে, সে বিষয়ে অনেকে সন্দেহ করেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন প্রত্যেক পরিবার মানে কী দলীয় পরিবার? এ প্রশ্ন যে একেবারে ফেলনা তা কিন্তু নয়। গত বছরের শেষ দিকে সরকার চাকরির জন্য সারাদেশ থেকে বায়োডাটা সংগ্রহের বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এর জন্য যদি কেউ বায়োডাটা দিয়ে থাকে তারা সবাই দলীয় লোক, কারণ বায়োডাটা সংগ্রহের এ ঘোষণা দলীয়ভাবেই হয়েছে, দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদেরকেই এ বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামে যে চারজনকে মনোনয়ন দিয়ে ন্যাশনাল সার্ভিস শুরু করেছেন তাদের বিষয়েও রয়েছে দলীয়করণের অভিযোগ, এর সাথে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে অনিয়ম ও ঘুষের অভিযোগও উঠেছে।বিষয়গুলো যদি সত্য হয়, পুরো পরিকল্পনাকেই করবে প্রশ্নবিদ্ধ। এভাবে শেষ পর্যন্ত এটি সফলতার মুখ দেখবে কিনা এ বিষয়ে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে। সেজন্য সরকারকে অন্তত এসব বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় এ প্রকল্পে অল্পদেরই স্থান দেয়া সম্ভব হবে। তার ওপর যদি উঠে দলীয়করণ আর দূর্নীতির অভিযোগ সেটা জনগণ মেনে নেয়ার কথা নয়। এ অবস্থাভাবাপন্নের দিক থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই পুরো প্রকল্প পরিচালনা করা উচিত।সরকার বেকারত্ব ঘুচানোর জন্য এ প্রকল্পের পাশাপাশি, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিতভাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারে। সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানে এখনও অনেক জনবলের প্রচ- সংকট রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ১৪ তারিখ প্রকাশিত জাতীয় দৈনিকের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম উল্লেখ করা যেতে পারে- ‘লোকবল সংকটে ৩৮৭ রেলস্টেশনের ১০৬টিই বন্ধ। এভাবে ডাকবিভাগ, প্রাথমিক শিক্ষাসহ সরকারি বিভিন্ন সেক্টরে জনবল নিয়োগ দেয়ার অনেক পদই খালি আছে। ইতিমধ্যে ৩০তম বিসিএস-এর সার্কুলারও হয়ে গেছে। নিয়মিতভাবে নিয়োগের বিষয়টি অব্যাহত থাকলে একদিকে যেমন বেকার সমস্যা কিছুটা হলেও কমবে, অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোও ভালোভাবে চলবে।বর্তমান সরকার নির্বাচনী ইশতিহার এবং বিভিন্ন বক্তব্যে বেকারত্বের হার ২০২১ সাল নাগাদ বর্তমান ৪০ ভাগ থেকে ১৫ ভাগে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। সরকারের এ সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই নিয়োগের এসব অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। আমাদের দেশে যেমন নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়, পাশাপাশি বিদেশেও যাতে অধিক হারে জনশক্তি রফতানি করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এখনও বিভিন্ন দেশে আমাদের জনশক্তি কাজ করছে। এখনও বিদেশে আমাদের শ্রমিকরা কাজ করছে। এখন বিভিন্ন দেশে যারা কাজ করছে অধিকাংশই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নয়, ফলে এরা নিম্নমানের কাজ করছে, অল্পই বেতন পাচ্ছে। সরকারি এ প্রকল্প যদি শ্রমিকদেরকে ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেয়, বিদেশে গিয়েও তারা ভালো কাজ পাবে, ভালো বেতন পাবে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যারোর তথ্য মতে, এপ্রিল ২০০৯ পর্যন্ত বিদেশে কর্মরত জনশক্তির সংখ্যা ৫৫ লাখেরও অধিক। যেসব দেশে আমাদের জনশক্তি আছে সরকারিভাবে সেসব দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া দেশের আইন-শৃংখলাসহ সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো রেখে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করা দরকার। বেশি বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে, বর্তমানে কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তা, সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে এগুলো নিশ্চিত করা যায়।সরকারি চাকরিদানের প্রকল্প ন্যাশনাল সার্ভিসকে কার্যকরী করতে এর সচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দলীয়করণ মুক্তি আবশ্যক। চাকরির বাজারভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং প্রশিক্ষণের পর নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী চাকরির বন্দোবস্তই প্রকল্পের সুফল বয়ে আনবে। বেকারত্ব দূরীকরণে সমাজের সবাইকে সরকারের পাশাপাশি কাজ করলে অমরা বেকারত্বের অভিশাপ হতে কিছুটা হলেও রেহাই পাবো।

(দৈনিক ডেসটিনি 18 march2010)

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।