Mahfuzur Rahman Manik
ছাত্র রাজনীতি না দলবাজী?
মার্চ 24, 2010


ছাত্র রাজনীতি না দলবাজী?
মাহফুজুর রহমান মানিক
অনেকে বলেন ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আমি একমত নই। আমি মনে করি ছাত্র রাজনীতি চালু করতে হবে। ছাত্ররা এখন যে রাজনীতি করছে এটাকে হয়তো সবাই ছাত্র রাজনীতি বলবেন। এটা কীভাবে ছাত্র রাজনীতি হয়? এটা ছাত্র রাজনীতি নয়। ছাত্র রাজনীতি আমাদের দেশে বর্তমান নেই। এটা দলবাজী।১৮ জানুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া সশস্ত্র সংঘাতের কথা বলি। এটা কী কারণে হয়েছে, দলবাজীর কারণেই। বিদ্রোহী গ্রুপ পদ না পেয়ে বিদ্রোহ করেছে। দলবাজীর অন্যতম নিদর্শন হলো বিএনপি ঠিক করেছে ছাত্রদলের কমিটি। বিএনপি যাদেরকে তার দলের জন্য লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে যোগ্য মনে করেছে, তাদেরকেই কমিটিতে স্থান দিয়েছে। গত বছরের জুলাইতে প্রথম নতুন প্রথম চার সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি গঠন করে। পরে ২০১০ এর ১ জানুয়ারিতে ১০১ জনের কমিটি গঠনের কথা থাকলেও গঠন করা হয় ১৭১ জনের কমিটি। ছাত্রদলের এ কমিটি হলেও কার্যত কেউ আত্র নন। টাকা দিয়ে, লবিং করে অনেকে কমিটিতে স্থান নিয়েছেন বলে গণমাধ্যমের সংবাদ। এদের অধিকাংশই বিবাহিত। ব্যবসায়ী চাকুরীজীবিদের নিয়ে কমিটি। সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘাতে গুরুতর আহত হয়েছেন। তার বয়স চল্লিশের ওপরে। তার স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন। ছাত্রদলের এ কমিটিকে নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের ম্যাগাজিন মজা করে লিখেছে ‘আমরা শক্তি আমরা বল, বিবাহিত বৃদ্ধ দল”। এ কমিটির ওপর ছাত্রনেতৃত্ব দেয়ার অর্থ কী-দলবাজী। ছাত্রদলের কমিটি যেমন বিএনপি করেছে তদ্রুপ ছাত্রলীগের কমিটিও আওয়ামী লীগ করে থাকে।এ দলবাজীর কারণেই শিক্ষাঙ্গণে প্রতিনিয়ত হচ্ছে সংঘর্ষ। নিহত হচ্ছে শিক্ষার্থী। বন্ধ হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছাত্র রাজনীতির নামে এ দলবাজীর চিত্র নতুন নয়। এখন তো সেটা অহরহই ঘটছে। গত বছর এ ছাত্র সংঘর্ষের সংখ্য ছিলো কয়েক শ। সংঘর্ষে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নিহত হয়েছে মেডিকেলের শিক্ষার্থীসহ কয়েক জন।২০১০ শুরু না হতেই সে ধারা চালু হয়ে যায়। অস্ত্রের ঝনঝনানি বেজে ওঠে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মরিয়া ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন। রাজশাহী পলিটেকনিকে ছাত্র মৈত্রীকর্মী নিহত হওয়ার ঘটনা তার অনন্য নজীর। শিক্ষক লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটে। আর নিজেদের মাঝে গ্রুপ মারামারি তো লেগেই আছে।আজকে ছাত্ররাজনীতির নাম করে বড় বড় দলগুলো প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের লাঠিয়াল বাহিনী রাখছে। এদের নেতৃত্বে যারা আসেন তারা বড় নেতাদের অত্যন্ত স্নেহ ধন্য। এদের চলার খরচ মেটানোর ব্যবস্থাতো রয়েছেই টে-ারবাজী, চাঁদাবাজী। এগুলো ছাত্রদলবাজী।আমাদের বর্তমান এ ছাত্রদলবাজীর কারণে সরকার বদলের সাথে সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রূপও বদলে যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হলগুলো হয়ে যায় সরকারী দলের। মজার বিষয় হলো বিরোধীদলের ছাত্রদলবাজী যারা করেন নিজেরাই জায়গা করে দেন সরকাররি দলকে। কারণ তারাতো জানেন সরকারি দলে থাকতে অন্যের ওপর কতোটা অত্যাচার করেছেন। আগেই হল ছেড়ে দেন। অবশ্য আগেই হল না ছাড়লে যে তাদের রক্ষা নেই সেটাও বুঝেন। সরকারি দলের ছাত্রদলবাজরাতো আরো ক্ষীপ্ত। হলে তো নয়ই ক্যাম্পাসেও যায়গা হবেনা বিরোধীদলের। ক্যাম্পাসে আসলেই মাইর। লুকিয়ে কেউ ক্লাস করলেও ক্লাস থেকে ধরে এনে হলেও তাকে উত্তম মধ্যম দিতে হবে। এভাবে ক্ষমতাসীনরা ক্যাম্পাস এবং হল থেকে অন্যদের তাড়িয়ে নিজেদের প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এতেও স্বাদ মেটে না। নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দেখা দেয় কোন্দল। একক রাজত্বে কেউ ভাগ বসাতে আসলে তার রেহাই নেই। গত বছর ঢাকা মেডিকেলের একজন মেধাবী ছাত্র এ জন্যই প্রাণ হারান। দলবাজী থাকলে এভাবে কেয়ামত পর্যন্ত সংঘর্ষ চলতেই থাকবে। কোন সুরাহা হবে না।বর্তমান এ ছাত্র দলবাজী শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণতো নয়ই বরং অকল্যাণ বললেও অত্যুক্তি হবেনা। যার কারণে শিক্ষার্থী মাতা-পিতার কাছে উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি নিয়ে সোনার মানুষ হয়ে যাওয়ার পরবর্তে যাচ্ছে লাশ হয়ে, আহত হয় শিক্ষার্থী, লাঞ্ছিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটা নিশ্চয়ই কেউ চাইবেন না।দলগুলো ঠিকই এসব থেকে আয়দা লুটছে। ছাত্রদের ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসছে। টে-ার, চাঁদাবাজির ভাগ পাচ্ছে অনেক নেতা। মারামারিতে লেলিয়ে দেয়ার মতো সংঘবদ্ধ শক্তি পাচ্ছে। নানা কর্মসূচিতে কাজে লাগাতে পারছে। সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানে নিজেদের কায়েম করতে পারছে। এসব যদি পাওয়া যায় মন্দ কিসের! পড়াশোনায় গোল্লায় যায়, যাক।শিক্ষাঙ্গণে দলাদলি থাকবে না। ছাত্রদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানিক সংগঠন থাকবে। সে সংগঠনের নির্বাচন হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করবে। এখন ও অবশ্য ছাত্রদের ইউনিয়ন আছে, কিন্তু নির্বাচন নেই। নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। যেমন ডাকসু (ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন)। দুই দশক ধরে অচল। এভাবে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ছাত্র ইউনিয়নগুলো কয়েক বছর ধরে অচল।ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ছাত্রদের দলমুক্ত হতে হবে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর যে ছাত্র সংগঠন আছে তা আর থাকবে না। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ থাকবে না। বিএনপির ছাত্রদল থাকবে না। জাতীয় পার্টির ছাত্র সমাজ থাকবে না। এভাবে অন্যান্য দলের কোন ছাত্র শাখা থাকবে না। ছাত্ররা নিজেদের রাজনীতি নিজেরা করবে। তখন আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞার মতো ছাত্ররাজনীতির সংজ্ঞা হবেÑ ছাত্রদের দ্বারা ছাত্রদের জন্য ছাত্রদের কল্যাণে পরিচালিত রাজনীতিই ছাত্ররাজনীতি।এ ছাত্র রাজনীতি চালু হলে সরকার পরিবর্তনে পরিবর্তন হবে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র। হল দখল করতে কেউ আসবে না। কারো ভয়ে হল ও ত্যাগ করতে হবে না। ছাত্রদের ক্ষমতার ধান্দা থাকবে না। টে-ারবাজি আর চাঁদাবাজি করতে হবে না। পড়াশোনায় সবাই মনোযোগ দেবে। ছাত্ররাজনীতির গৌরবময় অতীতের কথা প্রায়ই শুনি, পড়ি। খুঁজি। ১৯৭১ এর পর আর এগুতে পারি না। ১৯৭১ এর আগের ইতিহাসই বলা গৌরবের। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ঐক্যবদ্ধ সকল ছাত্রের দৃপ্ত শপথের ফল। এরপর ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুথান এর পথ ধরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১। একাত্তরের পর স্বাধীন বাংলাদেশের নেতৃত্বে যারাই এসেছে নিজেদের স্বার্থে গঠন করেছে ছাত্র রাজনৈতিক দল। ছাত্রদেরকে সবাই নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তখন থেকেই ছাত্ররা যা করে আসছে তাকে আমরা ছাত্র রাজনীতি বলতে পারি না, সেটা দলবাজী। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে দলবাজীর সংঘর্ষ, সংঘাত, হত্যাকা-, টে-ারবাজী, চাঁদাবাজী তখনো আজকের মতো এতো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেনি। নব্বইয়ের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও ছাত্ররা ছিলো সোচ্চার। এরপর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলো। তখন থেকেই দলবাজীর চিত্র মানুষের সামনে ভয়ংকরভাবে উপস্থিত হয়। দেদারছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু হয় সংঘর্ষ। সে কলুষিত অধ্যায় যে শুরু হয়েছে দিন দিন তা বেড়ে আজ এক কঠিন রূপ ধারণ করেছে। এ বছরে এসে রাজশাহীতে হত্যাকা- এবং সর্বশেষ ১৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘর্ষ। প্রকাশ্যে অগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে। আহত হয়েছেন ছাত্রদলের সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ প্রায় ৫০ জন।বিবেকবান মানুষ মাত্রই এ ছাত্র দলবাজী বন্ধ হোক তা চান। মানুষ গড়ার আঙ্গিনায় মানুষ হওয়ার পরিবেশ চান। আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে ছাত্রসমাজকে তার মূল দায়িত্ব পালনের বিকল্প নেই। এ জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশের নেতৃবৃন্দের। রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র সমাজকে কীভাবে দেখতে চায়। তারা যদি চায় ছাত্ররা মারামারি করুক, নিহত হোক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হোক, পড়াশোনা গোল্লায় যাক। তো ঠিক আছে দলবাজী চলছে চলবে। দেশ যথা যায় যাক, আমার দল তো ঠিক আছে। আবার এরা যদি দেশের কল্যাণ চান। শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাস দেখতে না চান। গবেষণাগারে দেখতে চান ছাত্রদের। দেশের উন্নতি চানÑ সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। দলবাজী নয় ছাত্র রাজনীতি করবে ছাত্ররা। লেখাটা যখন শেষ করবো তখনি খবর পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী ইনস্টিটিউট শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিটের (আইইআরের) প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন। পরীক্ষার আগের রাতে (২১.০১.২০২১) এ ফাঁসের ঘটনা ঘটে। ভাগ্য ভালো কর্র্তৃপক্ষ পরীক্ষা স্থগিত করতে পেরেছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটা কতোটা ন্যক্কারজনক ঘটনা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটাই প্রথম প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা। এ ঘটনার সাথে জড়িত দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের ব্যাপারে একটি ছাত্র সংগঠনের কর্মী বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কী তথ্য আসে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যা ঘটে গেলো তা কীভাবে মানা যায়। এজন্য দল ক্ষমতায় আছে বলে কোন ছাত্র যাতে যে কোন খারাপ কাজের সাহস না সেটা ও বড় বিষয়। ছাত্রদের মূল রাজনীতি এ চ্যাঞ্জেময় পৃথিবীর সময়ের দাবী রাজনীতিবিদদের এ বোধোদয় আদৌ হবে কী না জানি না।

(ৈদিনক েডসিটিন ২৭ জানুয়াির ২০১০)

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।