Mahfuzur Rahman Manik
মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান আজও প্রাসঙ্গিক
ডিসেম্বর 26, 2024

আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধে উদ্দীপ্ত করে স্লোগান। স্লোগানে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর মসনদ। বিক্ষুব্ধ মানুষ যখনই একত্রিত হয়, স্লোগান হয়ে যায় তাদের ভাষা। একাত্তরেও মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে সুর হয়ে ওঠে বেশ কিছু স্লোগান। সেগুলো বাঙালিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা জুগিয়েছিল, তেমনি তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অন্তরেও কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব যখন বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’; এর মাধ্যমে বাঙালি দেশ স্বাধীন করার এক তেজোদীপ্ত উদ্দীপনা পায়। বস্তুত রক্ত কখনোই বৃথা যায় না, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে যেমন তার প্রমাণ হয়েছে, সাম্প্রতিক চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানও তার চাক্ষুষ সাক্ষী। ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানেও প্রেরণা জুগিয়েছিল বেশ কিছু স্লোগান। তবে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের সেসব প্রেরণাদায়ী স্লোগানই আজকের বিবেচ্য। 

প্রতিটি স্লোগানেরই একটা বার্তা থাকে, জেগে ওঠার আহ্বান থাকে এবং চিন্তার খোরাক থাকে। যদিও প্রায় সব ক্ষেত্রেই স্লোগান বানাতে চিন্তা করার ফুরসত কম থাকে। মাঠের আন্দোলনের মধ্যেই হয়তো হঠাৎ করে কারও মুখঃনিসৃত কথা স্লোগান হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান হিসেবে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়। এই স্লোগানে অনেক বাঙালি জেগে উঠেছিল দেশ স্বাধীন করার মহান দায়িত্বে। ‘বীর বাঙালি’ বলে মুক্তিযোদ্ধাদের কেবল একাত্তরের ওই সময়ের প্রেক্ষাপটই তুলে ধরা হয়নি, বরং এর আগে বাঙালির বীরত্বগাথাও সমানভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বীর যেহেতু পরাজয়ের তোয়াক্কা করে না, তার এগিয়ে চলাই ভবিতব্য। বাঙালি তাই অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে।

স্লোগানে সবচেয়ে বেশি ফুটে ওঠে সম্ভবত পরিচয়। সম্প্রতি যখন ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন আক্রান্ত হয়, তখন ঢাকার বিক্ষুব্ধ জনতা স্লোগান দিয়েছে ‘দিল্লি, না ঢাকা– ঢাকা, ঢাকা’। বস্তুত একাত্তরের রণাঙ্গনেই এমন স্লোগানের সূত্রপাত। মুক্তিযোদ্ধারা তখন স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘পিন্ডি, না ঢাকা– ঢাকা, ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব, না বাংলা– বাংলা, বাংলা’। সেই সময়ের স্লোগানের অর্থ ছিল, আমরা পাকিস্তানের বশ্যতা স্বীকার করব না, আমরা পাঞ্জাবের অধীন থাকতে চাই না, আমাদের আলাদা ভূখণ্ড আছে, বাঙালি হিসেবে আলাদা পরিচিতি আছে; আমরা স্বাধীন হতে চাই। অনুরূপভাবে আজও বলছি, আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমরা দিল্লির প্রভুত্ব স্বীকার করছি না। আমাদের ‘কেবলা’ দিল্লি নয়, ঢাকা। আমাদের রাজধানী, আমাদের স্বদেশভূমিকে আমরাই রক্ষা করব এবং এর পতাকা অন্যত্র আক্রান্ত হলে আমরা লড়াই করব। 

মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান সেই পরিচিতি, সেই স্বকীয়তার কথা বলছে– ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। অর্থাৎ পদ্মা, মেঘনা ও যমুনাবিধৌত মাতৃভূমি আমাদের দেশ। এটাই আমাদের ঠিকানা। এই মাতৃভূমির সুরক্ষা ও স্বাধীনতার দায়িত্ব আমাদেরই। পাকিস্তান বাহিনী চাইলেও এই ভূমি দখলে নিতে পারবে না। প্রয়োজনে এই ভূমির জন্য আমরা জীবন দেব। মুক্তিযোদ্ধারা তখন জীবন দিয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আরও অনেকে শহীদ হয়েছেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্লোগান হলেও যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন এই স্লোগান পুরোনো হবে না। এই স্লোগানের আলোকে অনেক সংগীতও রচিত হয়েছে; ভবিষ্যতে আরও হবে।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান স্লোগান ছিল– জয় বাংলা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যখন প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান, তখন লিখেছেন, ‘বাঙলা বাঙালির হোক, বাঙলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।’ নানা বিন্যাসে রূপান্তরিত হয়ে সেটি অবশেষে ‘জয় বাংলা’ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে মুখ্য হয়ে ওঠে।


জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিয়েছিল– ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’। সেই স্লোগানে ছাত্র-জনতা নেমে এসেছিল এবং গর্জে উঠেছিল। ঊনসত্তরে যেমন বাঙালির স্লোগান ছিল ‘আইয়ুবশাহি, জুলুমশাহি– নিপাত চাই, নিপাত চাই’; চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা তদ্রুপ জুলুমশাহির অবসান ঘটায়। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান বারবার ফিরে আসে। 

সমকালে প্রকাশ: প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।