Mahfuzur Rahman Manik
ভাবিয়া করিও বিশ্ববিদ্যালয়
নভেম্বর 20, 2024
student politics in private university

কয়েক দিন ধরে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে আন্দোলন করছেন। সোমবারের আন্দোলনে রেল ও সড়ক অবরোধে কলেজটির নিকটবর্তী মহাখালীসহ রাজধানীর অনেক এলাকায় তীব্র যানজট লাগে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়, আন্দোলনকারীরা কমলাপুরমুখী ট্রেনে ইটপাটকেল ছোড়ার কারণে নারী-শিশুসহ অন্তত পাঁচজন গুরুতর আহত হন। স্বাভাবিকভাবেই অন্দোলনটি মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার পরিবর্তে ক্ষোভ দেখেছে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তোলা কতটা যথার্থ– সে প্রশ্নও উঠেছে।

তিতুমীর কলেজ ঢাকার সেই সাত কলেজের একটি, যেগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। সাত কলেজের শিক্ষার্থীই সাম্প্রতিক সময়ে আন্দোলন করছিলেন, যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুক্তি দিয়ে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করে, তার অধীনে কলেজগুলোকে আনা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার বিষয়টি এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে স্বতন্ত্র অবকাঠামো তৈরি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়। বাস্তবতা হলো, এ সিদ্ধান্তে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাজি নয়। ভোগান্তিসহ নানা সমস্যার কারণে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা যেমন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও চাইছে সাত কলেজের কাঁটা তাদের গলা থেকে বের হয়ে যাক। গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল না করলে তারা সর্বাত্মক কর্মসূচিতে যাবেন।

তিতুমীর কলেজ সাত কলেজের অধীনে এবং পুরো সাত কলেজই এখন আলোচনায়। তাই সাত কলেজ সমস্যার সমাধানের বিষয়টিই সরকারের অগ্রাধিকারে থাকবে। সেটাই যখন ঝুলে আছে, তখন তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর দাবি অযৌক্তিক। অথচ তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার থেকে ‘কলেজ ক্লোজডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন। অর্থাৎ কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ। অন্তত এটা স্বস্তির যে, মঙ্গলবার কলেজের ভেতরেই তারা অবস্থান করেছেন। পুলিশও তাদের বের হতে দিচ্ছে না। কিন্তু তারা যেভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন, বিপদটা সেখানেই।
সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে হয়তো অস্বীকার করা যাবে না– তিতুমীর কলেজ অবকাঠামোগত দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার মতো। কিন্তু প্রশ্ন, এমন অবকাঠামোর সব কলেজকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বানাব কিনা? বানাতে গেলে কাল ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে আন্দোলনে নামবেন। পরশু ইডেন কলেজের ছাত্রীরা আন্দোলন করবেন। অতঃপর সব কলেজে আন্দোলন হতে পারে। এভাবে কোনো কলেজকে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় করার যুক্তি নেই। এমনিতেই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কম নেই। খোদ রাজধানীতে এখন যত বিশ্ববিদ্যালয় আছে, এখানে নতুন করে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন আছে কিনা– তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।

দেশে ইতোমধ্যে যত বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেগুলোতে মানসম্পন্ন পড়াশোনা নিয়ে উদ্বেগের কমতি নেই। বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার মান, অবকাঠামো, শিক্ষকসহ যেসব প্রয়োজন রয়েছে, তা নতুন সৃষ্টি হওয়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই নেই। এরই মধ্যে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান। এখনই প্রতিবছর ৬-৭ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। অথচ তাদের কর্মসংস্থানের তেমন ব্যবস্থা নেই। সেই কারণেও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তার অবকাশ রয়েছে বৈ কি।

তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা যেভাবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, তা নানা কারণে প্রশ্নের সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় করার বিষয়টি কোনো সাধারণ দাবি নয় যে, উপদেষ্টারা এসে এমনিতেই ঘোষণা দিয়ে দিতে পারবেন। ওপরে যে পরিস্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে, সেই আলোকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির ক্ষেত্রে বিস্তর গবেষণা ছাড়া হুট করে ঘোষণা দেওয়া বোকামি হতে পারে। এটা সত্য, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের মধ্যে মানগত বিভেদ আছে। কিন্তু বড় সত্য হলো, আজ দুনিয়ায় শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা, চাকরি কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতাই বড়। তারুণ্যের বলে বলীয়ান শিক্ষার্থী যদি নিজেকে আগামী দিনের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, তবে তিনি কলেজে পড়েছেন, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে– তা কখনোই বড় বিষয় হয়ে ওঠে না।

যে কোনো কলেজের শিক্ষার্থীদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন থাকতে পারে। তবে তাদের বুঝতে হবে, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নাম দিয়ে আদতে তেমন উপকার হবে না। কোনো কলেজকে সরকার তাড়াহুড়ো করে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিলে, তা প্রশাসনিক ঘোষণায় বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হতে গেলে যে ধরনের পূর্বশর্ত থাকা জরুরি, তা পূরণ করতে না পারলে এ ঘোষণাই সার হয়; কোনো কার্যকর ফল দেওয়ার কথা না। একটা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান বিতরণ করে না; নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে। তার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবল লাগে। জনবল মানে কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়; মানসম্পন্ন গবেষক, যা বর্তমানে দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়েই নেই। এহেন নামকাওয়াস্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় তিতুমীর কলেজের নাম যুক্ত হলে না লাভ হবে দেশের, না লাভ হবে শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষায় সরকারি তিতুমীর কলেজের অবদান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এ কলেজের শিক্ষার্থীদের মেধার স্বাক্ষর দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্পষ্ট। বিশেষ করে এটা মনে রাখতে হবে, কলেজটির ভাগ্য এখন সাত কলেজের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং এই কলেজগুলোর আপাতত একসঙ্গে চলাই মনে হচ্ছে ভবিতব্য। সুদূরপ্রসারী চিন্তার আলোকেই সাত কলেজের সমাধান করা দরকার। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত নিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে, যা কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের কল্যাণে আসবে। তিতুমীর কলেজের বিচক্ষণ শিক্ষার্থীরাও নিশ্চয় বাস্তবতা অনুধাবন করবেন। দেশের সামগ্রিক শিক্ষার স্বার্থেই তাদের অবস্থান বিবেচনা করা জরুরি।

সমকালে প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৪

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।