Mahfuzur Rahman Manik
ছোট্ট মুনতাহার ভারী লাশ
নভেম্বর 20, 2024

মুনতাহার নিখোঁজ হওয়ার খবর জানছিলাম সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে। ৫-৬ বছরের শিশুটি প্রায় আমার মেয়ের বয়সী। আশা করছিলাম, মেয়েটির খোঁজ পাওয়া যাবে। মেয়েটি ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু লাশ হয়ে। আরও মন খারাপের কথা, সিলেটের কানাইঘাটের মেয়েটির হত্যার অভিযোগে তার গৃহশিক্ষিকাসহ তিন নারীকে আটক করেছে পুলিশ। মুনতাহাকে মেরে ডোবায় পুঁতে রাখা হয়। শিশুটিকে হত্যার শক্ত কোনো কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। সংবাদমাধ্যমে এসেছে, আটককৃতরা পুলিশকে মেয়েটির বাবার সঙ্গে বিরোধের কথা উল্লেখ করে। 

সন্তান হারানোর বেদনা মা-বাবা কোনোভাবে মানতে পারেন না। দুনিয়ায় মায়ার বেড়াজাল এতটাই শক্ত, যে সন্তানের সাধারণ হাঁচি-কাশিতে বাবা-মা বিচলিত হয়ে যান, সেখানে এমন চিরবিদায়ের বেদনা অনুধাবন করা কঠিন নয়। ৫-৬ বছরের মেয়েরা কতটা চঞ্চল ও চটপটে থাকে; কীভাবে পুরো পরিবারটা মাতিয়ে রাখে, তা বোধ করি সবাই জানেন। কতটা নিষ্ঠুর হলে নিষ্পাপ, নিরীহ এই শিশুকে এভাবে মারা যায়! কতটা নির্দয় হলে মেয়েটিকে হত্যা করা যায়! পুলিশ বলছে, লাশ উদ্ধারের সময় শিশু মুনতাহার শরীরে কাদা লেগে ছিল। গলায় রশি জাতীয় কিছু প্যাঁচানো ছিল। এতে সন্দেহ করা হচ্ছে, গলায় কিছু দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করা হয়েছে। শিশুটির কতটা কষ্ট হয়েছে? কতটা যাতনা নিয়ে মেয়েটি আদরের এই দুনিয়া ছেড়েছে?
৩ নভেম্বর প্রতিবেশীর সঙ্গে খেলতে গিয়েছিল মুনতাহা। এর পর আর মেয়েটি মায়ের কোলে ফেরেনি। মা অপেক্ষা করছিলেন তাঁর নাড়িছেঁড়া সন্তানের জন্য। বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও কম উদ্বিগ্ন ছিলেন না। নিখোঁজের ঘটনায় কানাইঘাট থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছিল পরিবার। আদরের সন্তানকে খুঁজে পাওয়ার আশায় পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন মুনতাহার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, লাশ হিসেবে মুনতাহাকে পাওয়া গেল ছয় দিন পর! নিরপরাধ শিশুগুলো কেন বারবার এমন ভাগ্য বরণ করছে?

গত মাসের শেষে লিখেছিলাম কল্পনাকে নিয়ে। কল্পনা গৃহকর্মী ছিল। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় তাকে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছে। দাঁত উপড়ে ফেলা হয়েছে নির্যাতন করে। মেয়েটিকে অবশেষে চিকিৎসার জন্য হাসতাপালে ভর্তি করতে হয়েছে। সেই ঘটনাও সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তুলেছিল। আন্তর্জালে এসব ঘটনা আমাদের আলোড়িত করে সত্য, কিন্তু বাস্তবে আমরা কতটা হৃদয়বান? মুনতাহার হন্তারকরাও নিশ্চয় জানত– মেয়েটির কোনো অপরাধ নেই। তারপরও শিশুটিকে হত্যা করা হলো। মজার ছলেও যে আমরা শিশুদের কতটা নিপীড়ন করি, তা হয়তো নিজেরাও বুঝি না। কিন্তু সেটাই হয়তো শিশুটিকে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে দিচ্ছে। ফুলের মতো শিশুদেরও সেভাবেই যেমন তাদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে, তেমনি তাদের ফোটার ব্যবস্থা করাও সমাজের দায়িত্ব। অথচ তার বিপরীতে আমরা কী দেখছি?
কবি প্রার্থনা করেছেন– ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। মা-বাবাও সন্তানের সুখের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যান। সামর্থ্যের সবটুকু দিয়েও সন্তানকে ভালো রাখায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। অনেক সময় নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান। সন্তানের প্রতি এমন দরদ কি সবাই অনুভব করতে পারে? যে নারী সন্তান ধারণ করেন, তিনি জানেন তিলে তিলে কীভাবে সন্তানকে ছোট থেকে বড় করেন। সেই নারী কীভাবে অন্য সন্তানের সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করেন?

মুনতাহার মৃত্যুতে বেশি কিছু বলার নেই। মানবিকবোধ জাগ্রত হওয়াই বিনীত প্রার্থনা। মানবিক সমাজ না হলে এ ধরনের হৃদয়বিদারক অঘটন ঘটতেই থাকবে। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ নাকি সবচেয়ে ভারী। মুনতাহার বাবা এ ভার কেমন করে সইবেন?

সমকালে প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।