সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক এম শামসুল আলম
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহফুজুর রহমান মানিক
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় গঠিত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এনার্জি টেকনোলজির পরিচালক ছিলেন। তিনি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর পিএইচডি করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।
সমকাল: বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০-এর বিরোধিতা করেছিলেন আপনারা। অন্তর্বর্তী সরকার সে আইনের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন।
এম শামসুল আলম: আমরা দেখেছি, দেড় দশক ধরে জ্বালানি খাতে উন্নয়নের নামে নির্বিচারে একধরনের লুণ্ঠন করা হয়েছে। সেখানে অলিগার্কদের শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে হাতিয়ার ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০। আইনটি দুই বছরের জন্য করা হলেও বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি দ্বারা ২০২৬ সাল পর্যন্ত টেনে আনা হয়। এই আইনের মাধ্যমে যেমন দুর্নীতি, লুণ্ঠন আত্মসাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা ও লুণ্ঠনকারীকে সুরক্ষা দেওয়া হয়, তেমনি এই আইন দিয়েই পছন্দমাফিক বিনিয়োগকারী ও ঠিকাদারকে বাছাই করা হয়। সেজন্য এই কাজ করার সঙ্গে যারাই জড়িত ছিলেন, তারা সবাই অপরাধী। তাই ‘জ্বালানি অপরাধী’ হিসেবে তাদের বিচারের বিষয়টি এখন বিচার্য। তাছাড়া মূল্য ও ভর্তুকি হ্রাসের লক্ষ্যে এই আইনের আওতায় সম্পাদিত চুক্তিসমূহ বাতিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে সংশোধন করা জরুরি। সেজন্য আইনটি কেবল স্থগিত নয়, বাতিল হতে হবে। এই অবস্থায় আইনটি বাতিলের জন্য ভোক্তাদের পক্ষে ক্যাব সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হতে পারে।
সমকাল: দুই বছরের জন্য করা বিশেষ আইনটি কীভাবে ১৪ বছর পর্যন্ত টেনে আনা হয়? আমরা দেখছি গত দেড় দশকের আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে যেখানে ৩ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, সেখানে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামেই ব্যয় হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা …।
এম শামসুল আলম: যেহেতু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অবাধ লুণ্ঠনের সুরক্ষা কবচ হিসেবে আইনটি করা হয়, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই সরকারের মেয়াদকাল অবধি আইনটিকে বলবৎ রাখা হবে এবং মেয়াদকাল অবধি অর্থাৎ বিগত ৫ আগস্ট অবধি আইনটি বলবৎ ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সে আইন স্থগিত করায় ভোক্তারা খুশি হয়েছে। তবে ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে ভোক্তারা কেবল লুণ্ঠিত হয়েছে, তাই নয়, আরও অনেক কিছুর মাধ্যমে বছরের পর বছর তারা লুণ্ঠিত হয়েছে। পুঞ্জীভূত সেই লুণ্ঠনের পরিমাণ কত হতে পারে, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। এই আইনের আওতায় বিদ্যুৎ খাতে প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগে উন্নয়ন হওয়ায় এই ব্যাপক লুণ্ঠন সম্ভব হয়।
সমকাল: প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগ কতটা জরুরি ছিল?
এম শামসুল আলম: মোটেও জরুরি ছিল না। সংকটের বাহানায় এটি করা হয়। আপনি আইনটির নাম খেয়াল করুন– দ্রুত কথাটি জুড়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য আইনটি করা হয়েছে। বিগত সরকার যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানির যেই সংকট ছিল, তা দেখিয়েই ওই আইনটির যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতা দেওয়া হয়। উক্ত আইন বলে প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগে যাকে খুশি, যখন খুশি যত খুশি তত ব্যয়ে নিঃশর্তে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কথিত উন্নয়ন চলে। এর পরও আজ পনেরো-ষোলো বছর পর এসে আমরা ঠিক ওই সময়ের মতোই বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের সংকট দেখছি। বলা চলে সংকট নানা দিক দিয়ে নানাভাবে আরও তীব্র ও ঘনীভূত হয়েছে। ওই সময়ে বকেয়া পরিশোধের কোনো বিষয় ছিল না। তখন পাওয়ার প্ল্যান্ট তথা উৎপাদনক্ষমতা স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়নি। তবুও তখন হাজার হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন তৈরি করে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি করা হয়েছে। অথচ বিদ্যুৎ নেই। তখন বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের অক্ষমতা ছিল না, এখন তৈরি হয়েছে। তখন বিদ্যুতের মূল্য সেভাবে বৃদ্ধিও পায়নি আর মূল্যস্ফীতিও সেভাবে ঘটেনি, এখন সেসবই জাতিকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে।
সমকাল: জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি?
এম শামসুল আলম: জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিবিড়ভাবে জড়িত। এখন মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ, এর ৬০ শতাংশই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিজনিত। মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট এখন চরমে। লুণ্ঠনের অর্থ জোগানোর কারণে এমনটি হয়েছে। সরকার যদি সত্যিকার অর্থ জ্বালানি সংকটে দূর করার জন্য এই ব্যয় করত, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রকৃত উন্নয়নে সেই ব্যয় হলে আজ এই অবস্থা হতো না। লোডশেডিংও দেশে থাকত না। মূল্যস্ফীতিও হতো না এবং দেনার দায়ে দেশকে ডুবতে হতো না।
সমকাল: আপনি অলিগার্কদের কথা বলেছেন। আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগের শেষ দুই মেয়াদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নসরুল হামিদ। এ খাতে দুর্নীতির সঙ্গে তাঁর যোগসাজশের বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’। নিজের লোক নিয়োগ দেওয়াসহ আত্মীয়স্বজনের নামে কোম্পানি খুলে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে …।
এম শামসুল আলম: আজ আর এটিতে রাখঢাকের কিছু নেই। অলিগার্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সে সময়ের ক্ষমতাসীনরাই লাভবান হয়েছেন। এমনকি তারা নিজেরাও এর অংশ। আমরা সালমান এফ রহমান ও ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর কথা বলতে পারি। তাছাড়া লুণ্ঠনের সুবিধাভোগী ও দায়ভার যিনি মন্ত্রী, তাঁর ওপরই বর্তায়। তাছাড়া অন্যান্য যেসব অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে, তারপর আর কোনো কথা থাকে না।
সমকাল: বর্তমান সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়বে না। আপনার মত কী?
এম শামসুল আলম: আমি মনে করি, এটি জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। সেজন্য আমরা একে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এর সুবিধা জনগণের কাছে পৌঁছাতে হলে অনেক কিছু করণীয়। সেখানে পরিকল্পনামাফিক সংস্কার করতে হবে। আমরা সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে কিছু করণীয় প্রস্তাব করেছি, যেখানে ‘সংস্কার কমিশন’ গঠনের কথা বলেছি। কমিশন সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ন করবে। সে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে দেখা যাবে, লুণ্ঠনের কারণে বিদ্যুৎ ও জালানি খাতে যে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়ে আছে, মূল্য বৃদ্ধি করেও সমন্বয় করা যায়নি, সেই ঘাটতি দ্রুত কমে আসবে।
সমকাল: সেটা কি রাতারাতি সম্ভব?
এম শামসুল আলম: বিগত সরকার জ্বালানি খাতে যে গভীর সংকট তৈরি করে গেছে, রাতারাতি তা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার কমপক্ষে তিন বছর ক্ষমতায় থাকবে। তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনার আওতায় ভোক্তাদের অন্তর্ভুক্তিতে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন শুরু করা হলে তিন মাসের মধ্যে এর সুফল দৃশ্যমান হবে। লুণ্ঠনমূলক ব্যয় হ্রাস পাবে। মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা প্রশমিত হবে। ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। এখানে রূপান্তরের ব্যাপারে তিনটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। প্রথমটি নীতিগত। দ্বিতীয়ত অপচয় তথা সিস্টেম লস কমানোর কৌশল এবং তৃতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অতিরিক্ত ব্যয় কমানো। বস্তুত অতিরিক্ত ব্যয়বৃদ্ধির দ্বারা তছরুপ বা লুণ্ঠন করা হয়।
সমকাল: জ্বালানি খাতে নীতিগত কী পরিবর্তন দরকার বলে আপনি মনে করছেন?
এম শামসুল আলম: বিনিয়োগ না করে এতদিন সরকার জ্বালানি খাতকে রাজস্ব আহরণের বিশেষ খাত বলে মনে করত। সরকার এ খাতকে একদিকে লাভজনক করেছে, অর্থাৎ যত বেশি মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে তত বেশি সরকারের লাভ হয়েছে। সরকার ট্যাক্স-ভ্যাট পেয়েছে। সরকারি কোম্পানি থেকে মুনাফার ভাগ নিয়েছে। এখন বর্তমান সরকারকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, রাষ্ট্র এ খাতকে রাজস্ব বা মুনাফা আহরণের খাত হিসেবে দেখবে না। অর্থাৎ এ খাতে করপোরেট ট্যাক্স রহিত করতে হবে। সরকার ডিভিডেন্ডও পাবে না। সরকারি কোম্পানিগুলির সেবা মুনাফাভিত্তিক হবে না। জনগণের কোম্পানি হিসেবে তারা যতটুকু খরচ হবে ততটুকুই ভোক্তা দেবে। তাতে মুনাফা বা লাভ থাকবে না। সরকার ব্যবসায়ী হবে না। মানুষ সরকারের মুনাফাখোরের চরিত্রের রূপান্তর চায়। সরকারের কল্যাণকর চরিত্র দেখতে চায়।
সমকাল: এটা কি বাস্তবায়নযোগ্য?
এম শামসুল আলম: এটি সর্বসাধারণের দাবি। বাস্তবায়ন খুবই সহজ। এটি আমাদের স্বাধীনতার চেতনা ও রাষ্ট্রের দর্শন। ৭২-এর সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত। জ্বালানি খাতে তথা সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যা কিছু ঘটেছে, তা সবই ছিল সেই দাবি, চেতনা ও দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র্রের রূপান্তর ঘটেছে। সরকার বদল হয়েছে। তাই এটি বাস্তবায়নের এখনই সময়।
সমকাল: জ্বালানি খাতের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে এর সম্পর্ক কতটা?
এম শামসুল আলম: বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খাত মুনাফা ও রাজস্ব আহরণের খাত হওয়ায় যত মূল্যহার বাড়ে, সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা ও রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ে। ফলে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। সরকারের ভূমিকায় তাতে উস্কানি জোগায়। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এখানেই বিপত্তি। মুনাফাবিহীন কার্যক্রম ও সরকারের রাজস্ব আহরণ নিয়ন্ত্রণে থাকলে মূল্যবৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার প্রায় ট্যাক্স-ভ্যাট কমায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে তা কখনও হয়নি; যা লুণ্ঠন সুরক্ষার শামিল।
সমকাল: আপনি বলছিলেন, প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগের সুযোগ দেয় বিগত সরকার। প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হলে কী সুফল পাওয়া যাবে?
এম শামসুল আলম: তা অসাধু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের মোক্ষম অস্ত্র। জ্বালানি খাত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলে সেখানে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়। ঘুষ দিয়ে কাজ নেওয়ার প্রবণতা কমে। ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ পেয়ে দশ হাতে তা বিক্রি প্রতিরোধ হয়। সাব কন্ট্রাক্ট প্রবণতা কমে। এভাবে ব্যয়বৃদ্ধি অনেক কমে আসে।
সমকাল: এতদিন যারা কাজ পেয়েছে, সেজন্য অতিরিক্ত মুনাফাও নিয়েছে?
এম শামসুল আলম: অতিরিক্ত মুনাফা অতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ওপর বিইআরসির স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী বিনিয়োগকারীর মুনাফা প্রায় ৬ শতাংশ। বিগত সরকারের আমলে সে মুনাফা ছিল ক্ষেত্রবিশেষে ১২-১৮ শতাংশ। আইনানুযায়ী ৬ শতাংশের অধিক মুনাফা লুণ্ঠন বলে বিবেচিত হয়। এই লুণ্ঠনমূলক মুনাফায় সরকারের আয় ও উন্নতিও লুণ্ঠনমূলক। দিন শেষে দেখা যায়, দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির অজুহাতে দ্রুত লুণ্ঠন বৃদ্ধির জালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়ন আটকা পড়েছে। গণ-আন্দোলনের মুখে জ্বালানি রপ্তানি প্রতিহত হলেও নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ উন্নয়নে জাতীয় সক্ষমতা উন্নয়নে আগ্রহী না হয়ে সরকার আমদানিতেই বেশি আগ্রহী হয়েছে। জ্বালানি খাত উন্নয়ন আজ এক নির্মম পরিহাসের শিকার।
সমকাল: তার মানে ভোক্তা বরাবরই প্রতারিত হচ্ছে?
এম শামসুল আলম: তাতে কোনো সন্দেহ বা সংশয় নেই। তেল, গ্যাস, কয়লা, এলপিজি ও বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণে যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় এবং সেই সঙ্গে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠান মুনাফামুক্ত হয়, তাহলে ঘাটতি সমন্বয় হয়, মূল্যবৃদ্ধির অবকাশ থাকে না। ২০০৮ সালে পেট্রোবাংলা বিইআরসিতে গ্যাসের মূল্যহার ৬২ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব পেশ করে। গণশুনানিতে দেখা যায, কোনো ঘাটতি নেই। বরং বছরে ১৪০ কোটি টাকা লাভ হয়। বলা হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়হার ১২ টাকা। ঘাটতি ৪ টাকা। অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ। অথচ ক্যাব-এর বক্তব্য মতে, ৪০-৪৫ শতাংশ ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব। তার মানে সংস্কার যথাযথ হলে বিদ্যামান মূল্যহারে বিদ্যুৎ লসে নয়, লাভে থাকে এবং ভোক্তাকে প্রতারিত হতে হয় না।
সমকাল: আপনি বলছেন, অধিক লুণ্ঠনের জন্যই জ্বালানি আমদানিতে আগ্রহ বেশি। প্রশ্ন হলো, দেশীয় সক্ষমতা কীভাবে অর্জিত হতে পারে?
এম শামসুল আলম: গ্যাস খাত উন্নয়নে আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ২০০৯ সালে ভোক্তার অর্থে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠিত হয়। ২০২২ সালে বিইআরসির গণশুনানিতে বলা হয়, এই তহবিলের ৬৫ শতাংশ অর্থই খরচ হয়নি, অলস পড়ে আছে। দেড় দশক ধরে তহবিলের ৩৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত বিদেশি ঠিকাদারের বিল পরিশোধে। অথচ জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এ তহবিল কোনো কাজে আসেনি। তাতে বোঝা যায়, জ্বালানি ঘাটতি মোকাবিলায় নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ উন্নয়নের পরিবর্তে সরকার এলএনজি আমদানিতে অধিক গুরুত্ব দেয়। লুণ্ঠন প্রতিরোধে জাতীয় সক্ষমতা অর্জিত হলে জ্বালানি উন্নয়নে দেশীয় সক্ষমতা অর্জিত হবে। আমদানিতে আগ্রহ ভাটা পড়বে।
সমকাল: আমদানির কারণে গ্যাসের দামও বেড়ে যায় …।
এম শামসুল আলম: গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ খরচ না করে তথা দেশীয় সক্ষমতা উন্নয়নে অগ্রাধিকার না দিয়ে প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়েগে ১ হাজার এমএমসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন এলএনজি টার্মিনাল করা হলো, গ্যাসের চাহিদার ২১ শতাংশ এলএনজি আমদানি দ্বারা পূরণ করার ব্যবস্থা হলো। আরও ৪ হাজার এমএমসিএফডি গ্যাস আমদানি পর্যায়ক্রমে প্রক্রিয়াধীন রইল। সরবরাহের ২১ শতাংশ আমদানিতে গ্যাসের দাম বেড়ে গেল কয়েক গুণ। লাভজনক গ্যাস চরম ঘাটতির শিকার হলো। মূল্যহার বৃদ্ধি ও এলএনজি আমদানি কমিয়ে সরকার ঘাটতি ও ভর্তুকি কমানোর কৌশল গ্রহণ করে। তাতে সার, সেচ এবং বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন ব্যয় ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পায় এবং পাশাপাশি জনগণ অব্যাহত চরম বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ঘাটতির শিকার হয়।
সমকাল: আমাদের চাহিদাও নিশ্চয়ই বেড়েছে?
এম শামসুল আলম: আমাদের চাহিদা বেড়েছে বটে, সেজন্য আমদানি নিশ্চয়ই করতে হবে। তেল আমদানি বৃদ্ধি না করে, নিজস্ব গ্যাসের মজুত ও উত্তোলন বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধিতে অগ্রসর হলে জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকত। জনগণকে মূল্যবৃদ্ধি ও চরম জ্বালানি সংকটের অভিঘাতের শিকার হতে হতো না। বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হতো। উৎপাদিত বিদ্যুতের ৩৫ শতাংশ কেবল জ্বালানি তেলে উৎপাদন নজিরবিহীন। অথচ আমাদের মতো দরিদ্র দেশে সরকার নিজস্ব গ্যাসের মজুত বৃদ্ধি না করে জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানি বাড়াল। জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা রসাতলে গেল। জনগণের জীবন রক্ষার মতো মৌলিক অধিকার বিপন্ন হলো।
সমকাল: কয়লার কথা যদি বলেন?
এম শামসুল আলম: উন্মুক্ত খনিতে কয়লা উৎপাদন নিষিদ্ধ। মানুষ জীবনের বিনিময়ে নিষিদ্ধ হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে বড়পুকুরিয়ায় কয়লা উৎপাদন হয়। এই কয়লায় সেখানকার ৫৭৫ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে। কয়লা স্বল্পতার কারণে কখনই বছরে গড়ে উৎপাদনক্ষমতা ৪০ শতাংশও ব্যবহার হয়নি। অথচ ২৫০ থেকে ৫৭৫ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। ২০১৮ সালে কয়লা চুরির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রায় ১০ শতাংশ কয়লা কালোবাজারে চলে যায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লায় ৫ শতাংশ পানি বেশি দেওয়া হয় এবং কয়লার দামে সে-পানি বিক্রি হয়। নিজস্ব এই কয়লার দাম আমদানিকৃত কয়লার দাম অপেক্ষা অনেক বেশি। এই বিষয়গুলো সরকারের চারটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আসেনি। চুরি নয়, সিস্টেম লস বলা হয়েছে। দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের অভিঘাতের শিকার জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা কোন পর্যায়ে, ভাবা যায়?
সমকাল: আমাদের কয়লা ফুরিয়ে যাচ্ছে, প্রাকৃতিক গ্যাসও অবারিত নয়। বিকল্প হিসেবে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনা কেমন?
এম শামসুল আলম: নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে বিকল্প নেই। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়। উৎপাদন ব্যয় লুণ্ঠনমূলক এবং গড়ে ১৩-১৪ টাকা। এই উৎপাদন ব্যয় জরুরি বিবেচ্য বিষয়। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে না পারলে তা আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধিতে অন্যতম নিয়ামক হবে। সৌরবিদ্যুতের সুফল ভোক্তা পাবে না। মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতের শিকার হবে। বিদ্যুৎ আমদানি বাজার তৈরিতে সহায়ক হবে। পরিবেশ সুরক্ষার আওয়াজে পরিণত হবে। ছাদ এবং অব্যবহৃত জমি ব্যবহার করে ৫০ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। তাতে চার টাকার মতো খরচ পড়ে। প্রতিযোগিতামূলক বিনিয়োগে উৎপাদন হলে ৬-৭ টাকা বিক্রয় মূল্যহারে এ বিদ্যুৎ বাজার উন্নয়ন সম্ভব। তেমনটা হলে সৌরবিদ্যুৎ খুব ভালো বিকল্প।
সমকাল: পারমাণবিক বিদ্যুতে কতটা ভরসার জায়গা হতে পারে?
এম শামসুল আলম: পারমাণবিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও দামের বিষয়টি আগে আলোচনায় আসা দরকার। যে সৌরবিদ্যুৎ ৪ টাকায় উৎপাদন করা যায়। অথচ ১২-১৩ টাকা মূল্যহারে কেনা হচ্ছে। যে কয়লা বিদ্যুৎ পুরোনো মেশিনসহ নানা সীমাবদ্ধতায় ১০ টাকা ব্যয়হারে উৎপাদন হয়, সেই বিদ্যুৎ আমদানিকৃত কয়লায় উৎপাদন হয় ১৪ টাকারও বেশি ব্যয়হারে। পারমাণবিক বিদ্যুতের দাম যদি আদানির বিদ্যুতের মতো বেশি হয়, তাহলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ বিদ্যুতের ভূমিকা কী হবে? বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় তথা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়েই-বা কতটা ভূমিকা রাখবে? এমন সব প্রশ্নের মীমাংসার ওপর নির্ভর করছে এই বিদ্যুতের ওপর কতটা নির্ভর করা যায়।
সমকাল: জ্বালানি খাতে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত?
এম শামসুল আলম: অন্তর্বর্তী সরকারকে খাদ্য নিরাপত্তার মতোই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্যই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন বাণিজ্যিক খাত হিসেবে নয়, কৃষি খাতের ন্যায় সেবা খাত হিসেবে হতে হবে। এই বিবেচনায় ক্যাবের প্রস্তাবিত সংস্কার প্রস্তাবের আলোকে যদি সরকার জ্বালানি রূপান্তর বিবেচনায় নেয়, তাহলে মূল্যবৃদ্ধি ব্যতীত ঘাটতি সমন্বয় হবে। অচিরেই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
এম শামসুল আলম: আপনাদেরও ধন্যবাদ।