খাদ্যাভ্যাসের কারণে আমাদের প্রত্যেকের শরীরে সিসা থাকা স্বাভাবিক। সিসার যে কোনো মাত্রার উপস্থিতিই বিপজ্জনক। তার ওপর 'সহনীয়' মাত্রা অতিক্রম করা কতটা ভয়ংকর; বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ সেটিই ঘটেছে শিশুর ক্ষেত্রে। চলমান সিসাদূষণ প্রতিরোধ সপ্তাহ (২৩-২৯ অক্টোবর) উপলক্ষে ইউনিসেফের উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন ২৫ অক্টোবর প্রকাশ হয়। তাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশের সাড়ে ৩ কোটি শিশু উচ্চমাত্রার ক্ষতিকারক সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। গবেষণায় ২ বছর থেকে ৪ বছর বয়সী শিশু শতভাগের শরীরে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। শিশুর শরীরে সিসার উপস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। সিসার কারণে শিশুর বুদ্ধি ও বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। স্বাভাবিকভাবেই এটি শিশুর সার্বিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। তাতে লেখাপড়া এবং সামাজিক মিথস্ট্ক্রিয়ায় শিশুর সক্রিয় অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। যার প্রভাব বড় হলেও থেকে যায়।
সুস্থ শিশু আমরা তাকেই বলি, যার বিকাশ ও বর্ধন ঠিকমতো হচ্ছে। এগুলো নিশ্চিত করতে পারে শিশুর খাবার এবং অনুকূল পরিবেশ। প্রথম ছয় মাসে শিশুকে শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর পর ধীরে ধীরে শিশুকে স্বাভাবিক সব খাবারে অভ্যস্ত করতে হয়। আবার শিশুর অনুকূল পরিবেশ মানে তার খেলা, হাঁটাচলার ব্যবস্থা করা। কিন্তু যখনই শিশু বাইরের খাবার খাচ্ছে কিংবা খেলনার সংস্পর্শে আসছে, তখনই শিশুর শরীরে সিসার উপস্থিতির শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআর,বির গবেষণাতে ৯৬ পণ্যে সিসার উপস্থিতির বিষয়টি এসেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শিশুদের খেলনা, সব ধরনের রং, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, সবজি, চাল এবং মসলার নমুনায় সিসার উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া মানেই অবধারিতভাবে তা শিশুর শরীরে থাকা। খাদ্য কিংবা পানীয় তো বটেই, ত্বকের মাধ্যমে এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমেও সিসা দেহে প্রবেশ করতে পারে। শিশুদের শরীরে সিসা অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারে। আলোচ্য গবেষণার অংশ হিসেবে গ্রাম এলাকায় পরীক্ষা করা ৩০ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। শহর এলাকার অন্তঃসত্ত্বা মায়েরাও নিশ্চয় এর বাইরে নন।
শিশুরা রঙিন যে কোনো কিছু পছন্দ করে। অথচ রঙেই বেশি সিসা মিশ্রিত থাকে। শিশুরা যে লাল কিংবা হলুদ রঙের পেন্সিল ব্যবহার করে, সেখানেও সিসার উপস্থিতি বিদ্যমান। তার মানে, সব দিক থেকেই সিসা শিশুদের ঘিরে রেখেছে এবং এ চক্রের বাইরে যাওয়া কঠিন। কিন্তু আমাদের শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই হবে। এ জন্য প্রথমত সিসাদূষণ বন্ধ করতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিসাদূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সিসাদূষণের জন্য বেশি দায়ী সিসাযুক্ত ব্যাটারি। সংশ্নিষ্টদের তথ্যমতে, সিসাযুক্ত ব্যাটারি থেকে ৮০ শতাংশের বেশি দূষণ ঘটে। এ বিষয়ে সরকারের নানা নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে ব্যাটারি পুনঃচক্রায়ন প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেও যাঁরা ব্যাটারি পুনঃচক্রায়ন করেন, তাঁদের নিয়মের মধ্যে আনা জরুরি। একই সঙ্গে নিয়ম মেনে সবাই এটি করছেন কিনা, সেটিও তদারকি করা দরকার। সিসাদূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ বলে ঝুঁকিটাও আমাদের বেশি। তা ছাড়া সিসামুক্ত রং তৈরির উপকরণে পাঁচ গুণ খরচ হলেও তা করতে হবে। সে জন্য সিসামুক্ত রঙের উপকরণের ওপর শুল্ক্ক কমানোর বিষয়টি সরকারকে জোরালোভাবে বিবেচনা করতে হবে। খাদ্য উপকরণও সিসামুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমাদের শিশু তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে না উঠলে সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা করা কঠিন। যেখানে শরীরে সিসার আদর্শ মাত্রা শূন্য হওয়া উচিত, সেখানে অধিকাংশ শিশুর শরীরে মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি আমাদের শঙ্কিত না করে পারে না। শিশুখাদ্য ও শিশুর খেলনা সিসামুক্ত করতে সচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে পুষ্টিকর খাবারের মাধ্যমে সিসার প্রভাব প্রতিরোধ হতে পারে। কিন্তু প্রথমেই সিসাদূষণ রোধ ও সিসামুক্তির দিকেই নজর দিতে হবে। কারণ, এটি শুধু শিশু নয়, সবার জন্যই ক্ষতিকর।