যেখানে সিগারেট অনেকের কাছে ফ্যাশন হিসেবে গণ্য হয়; যেখানে বেশি দামের সিগারেট আভিজাত্যের পরিচায়ক; যেখানে সিগারেট আধুনিকতা বা স্মার্টনেস প্রকাশ করে; কিংবা অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, যেখানে সিগারেট বিনোদনের মাধ্যম; সেখানে তামাকমুক্ত দিবস বড় অসহায়। এই অসহায়ত্বের কাছে আজকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কর্তৃক প্রণীত দিবসটির প্রতিপাদ্য, 'তামাকের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ কর' ধোপে টিকে না। তারপরও বিষয়টি যখন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ তখন হু'র মতো সংগঠনের এ নিয়ে কথা বলার বিকল্প কী। সংস্থাটি প্রতিবছরই এর ঝুঁকি সম্পর্কে নানা তথ্য প্রকাশ করে। যেমন_ প্রতিবছর বিশ্বে ৬০ লাখ মানুষ ধূমপানের কারণে মারা যায়। এর মধ্যে ছয় লাখ আবার পরোক্ষ ধূমপায়ী। তা ছাড়া প্রায় সবাই তো জানেন, ক্যান্সারসহ নানা রোগের উৎস সিগারেট। এরপরও কিন্তু সিগারেট খাওয়া কমছে না। এমনকি এর বিরুদ্ধে নানা সময়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও নয়। দেশে প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধে আইন আছে। সে আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। অনেকে হয়তো জানেনই না আইন সম্পর্কে, যারা জানেন তারাও তা থোড়াই কেয়ার করেন। সম্প্রতি আবার শিল্পমন্ত্রী বলছেন, শিল্পকারখানায় প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ হচ্ছে। যদিও বিদ্যমান আইনেই বলা আছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর, সমুদ্র ও নৌবন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল, ফেরি, প্রেক্ষাগৃহ, আচ্ছাদিত প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটর হল, বিপণি ভবন, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্কসহ পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ; কিন্তু বাস্তবতা সবাই দেখছেন।
সিগারেটে সুখটান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে যারা দেখেন, ধোঁয়া কতদূর গেল, তাদের কাছে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে 'ধূমপান মৃত্যু ঘটায়' কিংবা 'ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর' লেখায় কী-ইবা আসে যায়। আর সচিবালয়ে বৃহস্পতিবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকের আগামী বছরের মার্চ থেকে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী দেওয়ার বাণীই-বা অমন কী। এসব কেবলই উপরি কথা। যেখানে সবাই গোড়া রেখে আগা নিয়েই টানাটানি করছেন।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তামাকের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে আজকের প্রতিপাদ্য কিংবা এ রকম প্যাকেটের গায়ে এর পরিণতির কথা লেখা বা ছবিসহ সতর্কবাণী প্রচারের যথেষ্ট প্রভাব থাকতে পারে। প্রভাব অবশ্যই রয়েছে। যেমন তামাকের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ হলে সরকার প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের রাজস্ব পাবে। কিন্তু এসব কথা বলে সিগারেট বন্ধ করা কতটা সম্ভব। যেখানে একালের তারুণ্যের ফ্যাশনসহ শুরুতেই কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে, সেখানে আসলে এসব পদক্ষেপের প্রভাব যৎসামান্যই বলা যায়। এমনকি এর দাম বৃদ্ধি ও প্রকাশ্যে বেচাবিক্রি নিষিদ্ধও এটি বন্ধ করতে পারবে বলে মনে হয় না। একই সঙ্গে তামাকের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগেও নয়।
আমরা যখন তামাকমুক্তি চাইছি, এটি যখন তামাকমুক্ত দিবস তখন বোধহয় পদক্ষেপটা সে রকমই হওয়া প্রয়োজন। তার জন্য সরকারের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়তো জরুরি না। এমনকি হয়তো পাহারার জন্য পুলিশের টহলেরও প্রয়োজন পড়বে না। প্রয়োজন কেবল এর বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা সৃষ্টি। যৌতুকের মতো একে যতক্ষণ সামাজিক অপরাধ হিসেবে দেখা না হবে, ততক্ষণ এ থেকে মুক্তির কথা বলা হাস্যকর। কারণ একটাই, সিগারেট এখনও ফ্যাশন হয়ে আছে। সবাই একে ঘৃণা না করলে এবং এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে না দাঁড়ালে একে চ্যালেঞ্জ করা অসম্ভব।
- সমকালে প্রকাশিত, ৩১ মে ২০১৫
- ই-সমকাল থেকে দেখুন
- ছবি: অনলাইন