স্বপ্নার পরিচয়টা একটু পরে জানি। তার আগে ১৮ জুলাই প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল দেখা যাক। দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ডে মোট ৭৮ দশমিক ৬৭ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছেন আর ফেল করেছেন ২১ দশমিক ৩৩ ভাগ শিক্ষার্থী। ফল জানার ক্ষেত্রে এতটুকুই যথেষ্ট হতে পারত, তবে সর্বোচ্চ গ্রেড হিসেবে জিপিএ ৫ এর খবরটা না জানলেই নয়। ৬১ হাজার তো কম কথা নয়। পরীক্ষা একটা হার-জিতের খেলা। খেলায় কেউ হারে, কেউ জিতে; তেমনি পরীক্ষায় কেউ পাস করে আবার কেউ ফেল করে। অবশ্য পার্থক্যটা হলো খেলায় কাউকে না কাউকে হারতেই হবে। পরীক্ষায় সেটা নেই, চাইলে সবাই পাস করতে পারে। তবে সবাই পাস করে না, এটাই চিরন্তন।
খেলার সঙ্গে যখন তুলনা দেওয়া হচ্ছে তখন বলে নেওয়া ভালো যে, খেলায় জয়ী এবং পরাজিত উভয় দলই আলোচনায় আসে। সবাই একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কোন দল জিতল, কোন কোন খেলোয়াড়ের নৈপুণ্যতার কারণে জিতেছে, দলের টিম ম্যানেজমেন্ট কেমন ছিল, প্রত্যেকের পারফরম্যান্সও আলোচনায় আসে। হারলেও ঠিক কোন কারণে দলটা হেরেছে, দলের দুর্বলতাগুলো কী কী, বিশেষভাবে কোনো খেলোয়াড়ের দুর্বলতা থাকলেও সেটা দেখা হয়। কিন্তু এ আলোচনা বা সমালোচনায় ব্যতিক্রমটা আমাদের পাবলিক পরীক্ষা। এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করলে সবাই আমরা দেখি কত ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। কতজন জিপিএ ৫ পেয়েছেন। কোন কোন বিভাগ ভালো করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের মন্ত্রীরাও যারা পাস করেছেন তাদেরই অভিবাদন জানান এবং তারা হিসাব করে দেখান আগের বছরের তুলনায় কত বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছেন। কত বেশি জিপিএ ৫ পেয়েছেন। গণমাধ্যমগুলোও যে এর বাইরে তা নয়।
অর্থাৎ এসব আলোচনা কৃতকার্য বা পাসকৃতদের নিয়েই। এর বাইরে যারা অকৃতকার্য হয়েছেন, পরীক্ষায় ফেল করেছেন তাদের জন্য কোনো আলোচনা নেই। তাদের মন্ত্রীরা সমবেদনা জানান না, তাদের স্টোরি পত্রিকায় আসে না, তাদের বন্ধুরা তাদের ব্যথায় ব্যথিত নন, তাদের পরিবার তাদের সাপোর্ট দেয় না, সমাজ তাদের ভালো চোখে দেখে না, সর্বোপরি তাদের কাছে জীবনটা হতাশা ছাড়া কিছু নয়। আর তাদের হতাশার একটা দৃষ্টান্তই স্বপ্না। যে স্বপ্নার কথা শুরুতেই এসেছে।
স্বপ্নার সংবাদটি এসেছে সমকালে। ১৯ জুলাই 'ঈশ্বরদীতে ছাত্রী ও চৌদ্দগ্রামের ছাত্রের ঢাকায় আত্মহত্যা' শিরোনামে প্রকাশিত খবরে পত্রিকাটি বলছে_ এ বছর প্রকাশিত এইচএসসির ফলে উত্তীর্ণ হতে পারেনি স্বপ্না। তার বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর ফেল করার খবর পেয়ে নিজ ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে স্বপ্না। একই খবরে পত্রিকাটি আরেক অকৃতকার্য শিক্ষার্থী শরীফুলের খবর দেয়। পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার দিন দুপুর আড়াইটায় মোবাইল ফোনে যখন জানতে পারেন ফেল করেছেন, সে খবর পেতে পেতেই ঢাকার মালিবাগে নিজেকে সঁপে দেন ট্রেনের নিচে। মারা যান শরীফুলও।
স্বপ্নাদের এ আত্মহনন আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। কারণ তাদের আমরা বোঝাতে পারিনি ফেল করা খুব সমস্যার নয়, বোঝাতে পারিনি জীবনটা আরও সুন্দর। ফেল করা মানেই জীবনের শেষ নয়। তাদের হতাশা আমরা কাটাতে পারিনি। উদাহরণ হিসেবে হয়তো আমরা এ দু'জনকে পেলাম বা বলা চলে গণমাধ্যম হয়তো তাদের তুলে এনেছে; কিন্তু এটা তো ঠিক, ফেল করা প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর পরিণতি তাদের মতো না হলেও হয়তো মনের দিক থেকে তারা তাদের মতোই।
ভয়ের কথা হলো, তাদের সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। এ বছরের সংখ্যাটারই হিসাব করি। ১০ বোর্ডে মোট পরীক্ষা দিয়েছিলেন ৯ লাখ ১৭ হাজার। এর মধ্যে ৭৮ দশমিক ৬৭ ভাগ অর্থাৎ ৭ লাখ ২১ হাজার জন পাস করেছেন আর ফেল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২১ দশমিক ৩৩ ভাগ মানে প্রায় দুই লাখ। দুই লাখ শিক্ষার্থী মানে কম কথা নয়। যেখানে পাস করা ৭ লাখ ২১ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে আলোচনা থাকবে, সেখানে অবশ্যই দুই লাখ ফেল করা শিক্ষার্থীর বিষয়েও আলোচনা থাকতে হবে। পরিমাণগত দিক থেকে হোক না সেটা কমবেশি। তাদের প্রতি সমবেদনা বা তাদের মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়াটা যেমন দরকার, তেমনি তাদের অকৃতকার্য হওয়ার কারণটাও বের করা জরুরি। বিশেষত গণমাধ্যমকে এ ভূমিকাটা ভালোভাবেই রাখা উচিত।
ফেল করা বিষয়ে একটা খবর অবশ্য প্রতিবছর দেখা যায়_ সেটা হলো ঠিক কতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। যেমন এ বছর ২৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীই পাস করেনি। এটি সংখ্যাগত সংবাদ হিসেবে ওই একদিনই আসে। এরপর যে তাদের নিয়ে ধারাবাহিক স্টোরি ছাপানো দরকার, তাদের দুর্বলতা বের করা দরকার এবং ফেল করা থেকে বের হওয়ার উপায় বাতলানো দরকার তা কিন্তু আর দেখা যায় না।
শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও সমান কথা। কোন শিক্ষার্থী প্রচ- সংগ্রাম করে, যেমন- কেউ রিকশা চালিয়ে, কিংবা মুদি দোকানে কাজ করে কিংবা অন্যের বাড়িতে ঝি খেটে পড়াশোনা করে যখন জিপিএ-৫ পায় বা পাস করে ঠিক তাদেরকেই আমরা অদম্য মেধাবী হিসেবে গনমাধ্যমে দেখি। অথচ অনেকের ক্ষেত্রে তো এরকম হতে পারে যে এর চেয়েও কষ্ট করে ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারেনি এবং পরীক্ষা দিয়েও পাস করেনি, তাদের খবর কিন্তু আমরা পাই না। অথচ তাদেরও পড়াশোনা চালিয়ে নেয়ার, পাস করার একটা অদম্য ইচ্ছা ছিলো। এবং তাদের খবর আমরা যদি জানতাম, সমাজ যদি তাদেরকে সাপোর্ট দিতো নিশ্চয়ই সে পাস করতো। আমরা এটা করছি না বলে হয়তো তাদের অদম্য ইচ্ছা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষাজীবন থেকে তারা ছিটকে পড়ছে।
এটি অবশ্য চিরন্তন; সবাই কেবল বিজয়ীদের কথা বলে। এটিও ঠিক, সংগ্রাম করে যারা পড়াশোনা করে ভালো ফল করেছে তাদের সবার খবরও যে সামনে আসে তা নয়, সবাইকে তুলে আনা হয়তো সম্ভবও নয়। তবে যেহেতু তাদের খবর আসছে এবং সেটা দেখে অনেকে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে, একই সঙ্গে ফেল করা সংগ্রামীদের খবরও আসা উচিত নয় কি এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসাটাও কি আমাদের দায়িত্ব নয়?