মূল : করনেলিয়াস পূর্ব
প্রেসিডেন্ট জোকো 'জোকোউই' উইদোদোর ছয় দিনব্যাপী দক্ষিণ এশিয়া সফরকে কেউ কেউ কূটনৈতিক দিক থেকে খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। গত বুধবার থেকে সোমবার পর্যন্ত সময়ে তিনি শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান (যাকে প্রায়শ মধ্য এশিয়ার দেশ বলা হয়) সফর করেন। এ সফরকে 'খারাপ' হিসেবে চিহ্নিত করার কারণ আসলে তার ব্যাপারে অনেকের ধারণায় গলদ রয়েছে, যেখানে অনেকেই তার পূর্বসূরি সুশিলো বামবাং ইয়োধোয়েনার সঙ্গে যখন তুলনা করেন, তখন জোকোউইকে সেভাবে পররাষ্ট্রনীতির নেতা হিসেবে দেখেন না। কারণ সুশিলো তার সক্রিয় কূটনীতি ও বিশ্বব্যবস্থায় ভূমিকার জন্য খ্যাতিমান ছিলেন।
সাধারণের দৃষ্টিতে দেখলে জোকোউইর দ্বন্দ্ব-সংঘাতগ্রস্ত আফগানিস্তান সফর নিয়ে প্রশ্ন করা যায়- তিনি কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাবুল গেলেন? কারণ তার সফরের কিছুদিন আগেই কাবুলে ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসের কাছে বোমা হামলা হয়। এর পরও তিনি সেখানে গিয়ে যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন, তার কোনো অর্জন নেই? অবশ্যই আছে। জোকোউইর পররাষ্ট্রনীতির দর্শনের দিকে তাকালে এটা বোঝা সহজ। অভ্যন্তরীণ বিষয়কেন্দ্রিক চিন্তাধারাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি প্রায়ই সাংবাদিকদের বলেন, একজন সাবেক ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি তার কূটনীতির মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বৈঠক থেকে বাস্তব ফল পেতে চান।
বলা চলে, তার এ সফরে তিনি যেমনভাবে তার অভ্যন্তরীণ মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন, একইভাবে আন্তর্জাতিক ঠাটও বজায় রাখার মাধ্যমে তার বাস্তব লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে গেছেন। এটি ইন্দোনেশিয়ার কূটনীতিতেও মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো তার সফরের মাধ্যমে আশা করেছিলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক বা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে একটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক ও নিরাপত্তাবলয় হিসেবে গড়ে তুলবেন। আসলে জোকোউই নতুন বছরের প্রথম সফর শুরু করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে আসিয়ান-ভারতীয় স্মারক সম্মেলন ও ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য। সে সম্মেলন ২৫ বছর ধরে আসিয়ান ও ভারতের মধ্যে এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় তার এ সফরে জোকোউই ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরেন, যেখানে তিনি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে আঞ্চলিক সম্পর্ক তৈরিতে ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকার ওপর জোর দেন। এর মাধ্যমে তিনি ইন্দোনেশিয়াকে বৈশ্বিক সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চলে প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হন।
২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইন্দো-প্রশান্ত সাগরীয় কৌশলের পরিকল্পনা করেন। গত নভেম্বরে (২০১৭) এ পরিকল্পনা ভালোভাবেই সামনে আসে, যখন চীনকে অবাক করে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন এ ব্যবসায়িক অঞ্চলে তার আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন। চীন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো অ্যাপেক (এশীয়-প্রশান্ত সাগরীয় অর্থনৈতিক সংস্থা) সম্মেলনের বৈঠকগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ব্যাপক মাত্রায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে।
যা হোক, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশের কক্সবাজারে জোকোউইর রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার মাথাব্যথারই বহিঃপ্রকাশ। যে রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের দেশ মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বৌদ্ধ ও দেশটির সামরিক বাহিনী দ্বারা নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ বছরই সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে দেশটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, মিয়ানমারই তাদের দেশ।
দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় জোকোউই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন। একই সঙ্গে তাকে দশকের পর দশক ধরে চলা এ অমানবিক ট্র্যাজেডির অবসানে ইন্দোনেশিয়ার চলমান প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন। এর আগে ইন্দোনেশিয়া রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সাহায্য পাঠিয়েছিল। অবশ্য প্রেসিডেন্ট কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেনো মার্শুদি কেউই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিস্তারিত এখনও প্রকাশ করেননি।
নয়াদিল্লিতে আসিয়ানের সম্মেলনের সময় প্রেসিডেন্ট জোকোউই মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। তিনিও সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অতিথি ছিলেন। যদিও সম্মেলনের পাশাপাশি জোকোউই ও সু চির মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। হয়তো জোকোউই এটা বুঝতে পেরেছিলেন, যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত সু চিকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কঠিন চাপ প্রয়োগের জায়গা এটি নয়। সু চি যদিও অতীতে গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার সঙ্গে মিয়ানমারের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক। ফলে এখন সু চিও রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে।
যেখানে জোকোউই ও বিশেষভাবে বললে ইন্দোনেশিয়া তার এ সফরের মাধ্যমে রোহিঙ্গা কূটনীতিতে সাধারণভাবে বললে খুব বেশি কিছু আশা করতে পারে না। তবে দেশে তার আসল লাভ রয়েছে, যেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র এক বছর বাকি।
রোহিঙ্গা ইস্যুর ভূমিকার পাশাপাশি জোকোউইর একটি বড় অর্জন, যেটি তার বিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারবে না যে, তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ও ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন। আসলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ইন্দোনেশিয়ায় রোহিঙ্গা একটি বড় ইস্যু। যদিও মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের কারণে মিয়ানমার এমনিতেই এখন বিশ্বেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাঁড়ানো ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জোকোউইর এ কার্যকর ভূমিকাকে তার আগামী বছরের নির্বাচনে জেতার ইস্যু হিসেবে উপস্থাপন খুব সরলীকরণই হয়ে যাবে। কারণ ইতিহাস বলছে, ইন্দোনেশিয়া অতীত থেকেই শান্তি সংস্থাপক হিসেবে কাজ করে আসছে। আমরা দেখেছি, কম্বোডিয়ায় শান্তি আলোচনায় ইন্দোনেশিয়া সফল হয়েছিল। দক্ষিণ ফিলিপাইনে যদিও আংশিকভাবে সফল। একইভাবে জাতিসংঘের অধীনে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার শান্তিরক্ষা মিশনেও ইন্দোনেশিয়া অবদান রেখে আসছে।
সতর্কতা, ধৈর্য ও অব্যাহতভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের হতাশা থেকে মুক্তি আসতে পারে। অন্যথায় জোকোউইর পদক্ষেপ উল্টো ফলও বয়ে আনতে পারে।
আসলে কূটনীতিকদের প্রচেষ্টার ফল অল্প সময়ের মধ্যে লাভ করা যায় না। এ জন্য কাজ করে যেতে হবে। মনে রাখা দরকার, আমরা রোহিঙ্গাদের অধিকার কখনোই ফিরিয়ে দিতে পারব না, যদি এর মাধ্যমে নিজেরাই কোনো স্বার্থসিদ্ধি লাভ করতে চাই।
- ইন্দোনেশিয়ার দ্য জাকার্তা পোস্ট থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
- সমকালে প্রকাশিত, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
- ই-সমকাল হতে দেখুন
- লেখক : জাকার্তা পোস্টের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক