Mahfuzur Rahman Manik
এনসিপি : তারুণ্যনির্ভর দলটি তরুণদের নিয়ে কী ভাবছে?
এপ্রিল 21, 2025

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘ইউনিক সেলিং পয়েন্ট’ নিঃসন্দেহে তারুণ্য। যে তরুণরা চব্বিশের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তারা রাজনৈতিক দল গড়ার মধ্য দিয়ে আরেক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। তরুণ নেতৃত্বের ডাকে সাড়া দিয়ে যেভাবে গত বছর সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, তার ফলেই দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে। এ কারণেই তরুণদের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি সে আস্থা কাজে লাগিয়ে কতটা রাজনীতি করতে পারবে; ভোটের মাঠের জটিল হিসাবে দলটি কতটা চমক আনতে পারবে, নিঃসন্দেহে তা দেখার বিষয়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির লক্ষ্য ‘দেশজুড়ে জনভিত্তি ও ভোট’ শিরোনামে রোববার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সমকাল। জনভিত্তি তৈরি হলেই ভোটের ময়দানে সুবিধা পাওয়া যায়। এই জনভিত্তি কতটা তৈরি হবে, তা নির্ভর করবে মানুষের কাছে দলটি কতটা পৌঁছতে পারবে এবং মানুষকে তাদের এজেন্ডা কতটা বোঝাতে পারবে। দলটি যে বাংলাদেশ পন্থার কথা বলছে, সেটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের মানুষের ভাগ্য বাংলাদেশের নাগরিকরাই নির্ধারণ করবে। নাগরিকদের দ্বারা এবং নাগরিকদের জন্যই বিশেষ করে যে রাজনীতি, তা দেশের মানুষকে জাতীয় নাগরিক পার্টি বোঝাতে পারলে জনভিত্তি তৈরি করাও সহজ হবে।

দেশের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ। এ তারুণ্য আজ নানাবিধ সংকটে জর্জরিত। তরুণদের নেতৃত্বাধীন নাগরিক পার্টির এ বাস্তবতা ভালোই বোঝার কথা। সে জন্য তরুণদের অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষ কর্মসূচি দলটির থাকতেই হবে। পাকিস্তানে আমরা দেখেছি, ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ সমর্থকদের একটা বড় অংশ তরুণ। তরুণদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। ইমরান খান এখন কারাগারে অবস্থান করলেও তার পক্ষে যারা মাঠে লড়াই করছেন, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ। আমরা জানি, ইমরান খানের দলও জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্যতম প্রেরণা। তারুণ্যের বেকারত্ব আমাদের বড় সমস্যা। জাতীয় নাগরিক পার্টির তরুণ নেতৃত্বকে বেকারত্ব ঘোচাতে অভিনব ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্য কেবল তরুণদের জন্যই নয়, সব শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের জন্যও দলটির কর্মসূচি থাকতে হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখার কারণেই দলটির প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। ২০১৮ সালে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছাত্র অবস্থায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ২০১৮ সালেই তারা কোটা সংস্কারের সফল আন্দোলন করেছিল। ২০২৪ সালে এসে কোটা সংস্কার দিয়ে শুরু হওয়া তাদের আন্দোলন সরকার পতন পর্যন্ত গড়ায়। বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের পরও যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়নি, সেখানে তারুণ্য অল্প দিনেই আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে যে তরুণ সমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে; বিগত সরকার নির্দয়ভাবে তাদের অনেককে হত্যা করে। অন্তত দেড় হাজার শহীদের কথা আমরা জানি। তাদের রক্তের ওপরেও দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সে জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে শহীদদের আত্মত্যাগ তাদের স্মরণে রাখতে হবে।

স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার হওয়ার পরও জনপ্রত্যাশা পূরণের সরকার সে অর্থে দেখা যায়নি। জাতীয় নাগরিক কমিটি সেই স্থান পূরণ করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ এতটা সহজ নয়। তা ভেবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের বিপরীতে নাগরিক পার্টি কী বয়ান নিয়ে হাজির হচ্ছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে নেতাদের চাঁদাবাজি, দখল, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায়। জাতীয় নাগরিক পার্টির তৃণমূল হতে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীকে এ ধরনের অন্যায়ে যুক্ত হওয়া যাবে না। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃত্বে এসেছেন চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সরকারের উপদেষ্টা থেকে পদত্যাগ করে এসেছেন। অন্যান্য নেতৃত্বকেও মানুষ দীর্ঘ সময় না হলেও অনেক দিন ধরেই দেখে আসছেন। তারা অন্যায়ের কাছে আপসহীন হবেন– এটাই প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে, রাজনীতির পথ ফুল-বিছানা নয়। এখানে সাফল্য পেতে দীর্ঘ সাধনা প্রয়োজন, যেখানে জেল-জুলুম-নির্যাতনের শঙ্কা নিত্যসঙ্গী। যারা রাজনীতি করেন, এটা ঘোষণা দিয়েই করেন– তারা দেশ ও দশের সেবা করতে চান। তাদের কাছে যেন নিজের উন্নতির চেয়ে দেশের উন্নতিই মুখ্য। তার ক্ষমতা পাওয়ার মূলেও রয়েছে দেশ আর সবার গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা। দিনশেষে জনগণের কাছে জবাবদিহির মানসিকতাও রাজনীতিকদের থাকা জরুরি।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান বড় সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। দেশের অনেক জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন। অভ্যুত্থানের পর সে জন্যই সংস্কারের আলোচনা প্রধান হয়ে উঠেছে। নাগরিক কমিটির মতো অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারীদের দলের মাধ্যমেই সে সংস্কার বাস্তবায়ন হতে পারে।
বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে যে তরুণরা একদিন আন্দোলনে নেমেছে, আজ তারাই অভ্যুত্থানের মতো সাফল্য এনে দিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে রাজনীতিতে নিয়োজিত। সুতরাং দেশকে বৈষম্যমুক্ত করতে হবে। দেশের তরুণদের জন্য গতানুগতিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান নিয়ে গবেষণা করেই পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত নেওয়া চাই। দেশের প্রয়োজনে তারুণ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহারের পথরেখাও সমান দাবি রাখে।

সমকালে প্রকাশ: ৩ মার্চ ২০২৫

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।