
আমাদের অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকা অনুসারে পরিচালিত হয় বলে এই বর্ষের বিদায় ও আগমন নিয়ে বাড়তি আয়োজন লক্ষণীয়। আন্তর্জাতিকভাবেও এই ক্যালেন্ডার প্রচলিত বিধায় দেশে ও বিদেশে এর কদর বেশি। সংবাদমাধ্যমে বিশেষ আয়োজন থাকে পুরোনো বছর কেমন গেল, নতুন বছর কেমন যাবে ইত্যাদি নিয়ে। খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনে বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে এক ধরনের বিশেষ উৎসাহ লক্ষণীয়। ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ যেভাবে আড়ম্বরে আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানোর মাধ্যমে উদযাপনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার নেতিবাচক দিকও সামনে আসছে। যে কারণে আমরা দেখেছি চলতি ডিসেম্বরের মধ্যভাগ থেকেই সরকারের পক্ষ হতে বারবার আতশবাজি, পটকা ফুটানো ও ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে।
ঢাকা এমনিতেই শব্দ ও বায়ুদষণে নাজুক। আতশবাজি পোড়ানো কিংবা ফানুস ওড়ানোর যে প্রবণতা চলে আসছে, তাতে দূষণ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। বস্তুত ঢাকার বায়ুদূষণ এমন ‘অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটি প্রায় প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমের খবর হিসেবে উপস্থাপিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় বায়ুদূষণ বেশি হওয়ার কারণে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের র্যাংকিংয়ে ঢাকা প্রায়ই শীর্ষে থাকে। এমনকি কখনও কখনও ‘মোস্ট পলিউটেড সিটি’র র্যাংকিংয়ে শীর্ষস্থানও দখল করে। কলকারখানার ধোঁয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, নির্মাণকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ময়লা-আবর্জনার বর্জ্য পোড়ানো ইত্যাদি কারণে বায়ু দূষিত হয়। এ ছাড়া মানবসৃষ্ট নানা কারণে বাতাস দূষিত হয়। খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনসৃষ্ট দূষণও এর বাইরে নয়। নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে যে আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানো হয়, তাতে কী পরিমাণ বায়ু দূষিত হয়, সে চিত্রও গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
শুক্রবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলন করে ক্যাপস জানিয়েছে, আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানোর কারণে রাজধানী ঢাকায় গত সাত বছরে বায়ুদূষণ বেড়েছে গড়ে ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে একই কারণে শব্দদূষণ বেড়েছে গড়ে ৭৪ শতাংশ। ঢাকা এমনিতেই বায়ুদূষণে নাজুক; শব্দদূষণও এখানে অনেক বেশি। এ অবস্থায় খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে যেভাবে ঢাকাবাসী এই দূষণে অংশ নেয়, সেটি দৃষ্টিকটু। বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে নাগরিকদের মধ্যে আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানোর যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা আমরা দেখে আসছি, তার শব্দ ও বায়ুদূষণের চিত্রটি ক্যাপসের গবেষণায় যথার্থভাবেই ফুটে উঠেছে। কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব শুধু শব্দ কিংবা বায়ুদূষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
নববর্ষে আতশবাজি পোড়ানো ও পটকা ফুটানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে শুক্রবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এর উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে। অতিরিক্ত শব্দের কারণে শ্রবণ ও স্মরণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, কান ভোঁ ভোঁ করা, মাথা ঘোরা, হৃদরোগের ঝুঁকি, মানসিক অস্থিরতা, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিসহ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যার কথা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। এর আগে এক ‘থার্টিফার্স্ট নাইটে’ এমন শব্দে ভয় পেয়ে হৃদরোগে শিশুমৃত্যুর বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ নববর্ষ উদযাপনে জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে সরকার।
এর আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও আতশবাজিসহ ফানুস না ওড়ানোর কথা বলেছেন। এমনকি পুলিশের পক্ষ থেকেও এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। ক্যাপসের গবেষণা, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুরোধ সত্ত্বেও প্রশ্ন হলো, ঢাকায় এবার কি নববর্ষে আতশবাজি, পটকা ফুটানো কিংবা ফানুস ওড়ানো কমবে? প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার যেভাবে নিষেধ করা হচ্ছে, তাতে এ প্রবণতা কমতেও পারে এবং কমাই জরুরি। নগরবাসী নিশ্চয় বাস্তবতা অনুধাবন করবেন।