
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাপনে কিছু স্বস্তি আনতে যে বিশেষ ভাতা দেওয়া হয়, সেটিই মহার্ঘ ভাতা। বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এই মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মহার্ঘ ভাতা এই মুহূর্তে জরুরি। সরকারি চাকরিজীবীদের সর্বশেষ ২০১৫ সালে পে স্কেল নির্ধারণ করা হয়। নতুন পে কমিশনই দরকার ছিল। পে কমিশন সময়সাপেক্ষ বলে অন্তর্বর্তী সরকার মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রশ্ন হলো, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির শিকার সাধারণ মানুষের– যারা সরকারি চাকরিজীবী নন– কী হবে?
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি চাকরিজীবী প্রায় ১৪ লাখ। তবে বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এ সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। তাদের পরিবার মিলে সুবিধাভোগী হয়তো কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তার মানে বিপুল সংখ্যক মানুষই এই মহার্ঘ ভাতার বাইরে থাকছে। সরকারি কর্মীরা যে বাজারে বাজার করেন, মূল্যস্ফীতির চাপে পড়া ওই সাধারণ মানুষ কিন্তু সেই বাজারেই যান। এমনকি তাদের জন্য মহার্ঘ ভাতা দ্বিগুণ মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। মহার্ঘ ভাতার কথা শুনে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
তাই সরকারের করণীয় অনেক। প্রথমটি হলো, নতুন করে বাজারকে অস্থিতিশীল না হতে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, বাজার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে আসা। তৃতীয়টি হলো, যারা বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তাদের বেতন কিংবা মজুরি বাড়ানোর বিষয়েও সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বলাবাহুল্য, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দিয়ে আসছে। এ সরকারের প্রথম মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও সর্বশেষ নভেম্বরের চিত্র হতাশাজনকই বলতে হবে। বিবিএস সূত্রে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যে পরিসংখ্যান প্রকাশ হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। অথচ আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ নানা পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও এ সরকার প্রথম মাসের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে পারেনি। কারণ হিসেবে, মোটা দাগে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কথা বলা যায়, যেটা সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্যেও এসেছে। এই সিন্ডিকেট কতটা শক্তিশালী তা সাম্প্রতিক বাজার থেকে ভোজ্যতেল উধাও হওয়ার ঘটনায় স্পষ্ট। এখন সে অর্থে রাজনৈতিক দল নেই তারপরও কেন সরকার তাদের নির্মূল করতে পারছে না?
এ প্রেক্ষাপটেই মহার্ঘ ভাতা আসছে। ইতোমধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে, যারা কার্ডধারী তাদের জন্য সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পণ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমেও ৩০ টাকা কেজিতে চাল কিনতে পারছে অনেকে। বলা যায়, একদিকে সরকারি চাকরিজীবীরা মহার্ঘ ভাতা এবং অন্যদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা ও খাদ্য কর্মসূচি কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে। মাঝখানে মধ্যবিত্তের বৃহৎ অংশ পড়ছে ফাঁকিতে। মধ্যবিত্তের অনেকের অবস্থা এমন যে, বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। একটা দীর্ঘসময় ধরে এই মূল্যস্ফীতির চাপে সংকটে পড়ে আছে মানুষ। অর্থনীতির যে শ্বেতপত্র সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে, তাতে দেখানো হয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য ও অসমতা বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠেছে।
এমন অবস্থায় সরকারি চাকরিজীবীদের মহার্ঘ ভাতা অবশ্যই দরকার। বস্তুত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেই ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল সরকার। পরে তা কার্যকর না হলেও মূল বেতনের ৫ শতাংশ বাড়তি প্রণোদনা দেওয়া হয়। সেটিও খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না। সেজন্যই মহার্ঘ ভাতা তাদের বকেয়াই ছিল বলা চলে।
তবে, সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত দ্রব্যমূল্য। নভেম্বরের চিত্রে দেখা যাচ্ছে, সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। সম্প্রতি এই মূল্যস্ফীতি আগামী জুনের মধ্যে সাত শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বস্তুত সাত শতাংশ বা তার নিচে থাকাই আদর্শ। এই মানে রাখা গেলে সরকারি চাকরিজীবীদের যেমন মহার্ঘ ভাতার প্রয়োজন হবে না, তেমনি দেশের সব মানুষই স্বস্তিতে বাজার করতে পারবে। সরকারকে এজন্য অতিরিক্ত ভাবতেও হবে না। তা না হলে মহার্ঘ ভাতা দিয়েও সরকারি চাকরিজীবীরা সংসার চালাতে হিমশিম খেতে পারেন। আর সাধারণের কথা তো বলাই বাহুল্য। অর্থাৎ এতে সরকারের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হলেও সুফল পাওয়া যাবে সামান্য। বাজারের দিকেই দিনশেষে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। বাজারে যেহেতু সব মানুষের স্বার্থ জড়িত, এখানকার সংকট চিহ্নিত করে সমাধান করলে এবং দ্রব্যমূল্য কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে কমালে তা সবারই উপকার করবে।