Mahfuzur Rahman Manik
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন
নভেম্বর 20, 2024

মুহাম্মদ ইউনূস

 ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

আমি জলবায়ু সংকটকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপস্থাপন করতে চাই। এই দৃষ্টিভঙ্গি জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবিলার পাশাপাশি আরও হানিকর পরিস্থিতির দিকে যাওয়া ঠেকাবে। এটা অনেক বড় কাজ এবং বড় প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। তিন শূন্যের নতুন পৃথিবী গড়ার ব্যাপারে আমার দীর্ঘদিনের যেই স্বপ্ন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে চাই।

জলবায়ু সংকট আরও গভীর হচ্ছে। আমাদের সভ্যতা এক বড় ঝুঁকির মধ্যে। কারণ আমরা অব্যাহতভাবে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে, এমন মূল্যবোধই লালন করছি। একটি নতুন সভ্যতার ভিত গড়তে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা, অর্থনৈতিক ও তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে, যাতে আমরা নিজেদের সুরক্ষা দেয় ও নিজেদের উদ্দীপ্ত করে এমন সভ্যতা গড়তে পারি।

আমরা, এই পৃথিবীর অধিবাসীরাই পৃথিবী ধ্বংসের কারণ। আমরা জেনেশুনে এই ধ্বংস প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা এমন এক জীবনধারা বেছে নিয়েছি, যা পরিবেশের বিপরীতে কাজ করছে। আমরা একে এমন অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ন্যায্যতা দিয়েছি, যেন বৈশ্বিক ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক। এই অর্থনৈতিক কাঠামো মানুষকে সীমাহীন ভোগবাদে উৎসাহ দেয়। আপনাকে বেশি ভোগ করার জন্য বেশি উৎপাদন করতে হবে। যত বেশি উৎপাদন করবেন, তত বেশি অর্থ কামাতে পারবেন। অর্থাৎ আমাদের সব কর্মকাণ্ডের মূলে আছে সর্বোচ্চ লাভের ওই আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষাই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সব কিছুকে পরিচালনা করে।

বেঁচে থাকার জন্য আমাদের এক ভিন্ন সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। ভিন্ন জীবনপ্রণালির ভিত্তিতে তৈরি হবে এই পাল্টা সংস্কৃতি। এর ভিত্তি হবে শূন্য বর্জ্য। শূন্য বর্জ্যের নীতি মানুষের ভোগে লাগাম দেবে। এতে কোনো বর্জ্য অবশিষ্ট থাকবে না। এটা সেই জীবনধারা, যেখানে কার্বন নিঃসরণ নামবে শূন্যের ঘরে; কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি মানুষ ব্যবহার করবে না। মানুষের চাহিদা মেটাবে কেবল নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এই অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত কোনো মুনাফার ব্যবস্থা থাকবে না। এটি এমন অর্থনীতি, যেটি প্রাথমিকভাবে গড়ে উঠবে শূন্য ব্যক্তিগত লাভের ভিত্তিতে। অর্থাৎ এটি হবে সামাজিক ব্যবসা। এটি এমন ব্যবসা কাঠামো, যেখানে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যার সমাধানই হবে মুখ্য; মুনাফা অর্জন নয়। সামাজিক ব্যবসা এক বিশাল জগৎ, যার বড় একটি অংশ মনোযোগী হবে পরিবেশ ও মানব জাতির সুরক্ষায়।

এই ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা হবে একেবারে সুলভ, যার মাধ্যমে মানবজীবন কেবল সুরক্ষিত থাকবে না; একই সঙ্গে গুণগত যাত্রাও চলমান থাকবে। সামাজিক এই ব্যবসা তরুণদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। তরুণ প্রজন্ম উদ্যোক্তা হওয়ার নতুন দীক্ষার মাধ্যমে যথাযথভাবে প্রস্তুত হবে। এখন শিক্ষা যেভাবে চাকরি খোঁজার মানুষ বানাচ্ছে, এটি তখন উদ্যোক্তা হওয়াতে রূপান্তরিত হবে। অর্থাৎ উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক শিক্ষা।

পরিবেশের সুরক্ষার জন্য নতুন জীবনপ্রণালি দরকার। এই জীবন পদ্ধতি কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না, বরং নিজের গরজেই মানুষ তা বেছে নেবে। তরুণ প্রজন্ম সেই জীবনপ্রণালি ভালোবেসেই বেছে নেবে। প্রত্যেক তরুণ তিন শূন্য ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠবে। তার মানে, তারা কোনো কার্বন নিঃসরণ করবে না; কোনো সম্পদ গড়াতে মনোযোগ দেবে না; তারা কেবল সামাজিক ব্যবসা গড়বে এবং কোনো বেকার থাকবে না। অর্থাৎ প্রত্যেকে নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে নিয়োজিত করবে। এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিই তিন শূন্য নীতির মধ্যে বাস করবে এবং এই নীতিতেই তার জীবন পরিচালনা করবে। এর মাধ্যমেই তৈরি হবে নতুন সভ্যতা।

এটা করা অসম্ভব নয়; সম্ভব। সে জন্য আমাদের দরকার হলো নতুন জীবনপ্রণালি গ্রহণের মানসিকতা। এই জীবনপ্রণালি পৃথিবীর সুরক্ষার সঙ্গে একীভূত এবং যারা এই পৃথিবীর মধ্যে বাস করবে, তাদের সবাইকে তিন শূন্য নীতি সুরক্ষা দেবে। আজকের তরুণ প্রজন্ম এর পর বাকিটা করবে। তারা তাদের পৃথিবীকে ভালোবাসে।
আমি প্রত্যাশা করি, আপনারাও এই স্বপ্ন দেখায় যুক্ত হবেন। আমরা যদি একত্রে এই স্বপ্ন দেখতে পারি, তবেই এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা; আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত কপ২৯ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বুধবার প্রদত্ত ভাষণ; ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর

সমকালে প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।