Mahfuzur Rahman Manik
এই শিক্ষা ও দক্ষতা দিয়ে শ্রমবাজার ধরে রাখা কঠিন হবে
অক্টোবর 11, 2024

সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. এম. নিয়াজ আসাদুল্লাহ

ড. এম. নিয়াজ আসাদুল্লাহ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি প্রফেসরিয়াল ফেলো, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের ভিজিটিং প্রফেসর। ইতোপূর্বে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়া (২০১৪-২২) ও মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে (২০২২-২৪) অধ্যাপনা করেছেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষা বিভাগের স্কিল, নলেজ ও অর্গানাইজেশনাল পারফরম্যান্স সেন্টারের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট নিয়াজ আসাদুল্লাহ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে শিক্ষার অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ভারতের আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির স্নাতক এবং অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। জার্নাল অব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট, সিঙ্গাপুর ইকোনমিক রিভিউসহ বিভিন্ন একাডেমিক জার্নালের এই সম্পাদকের জন্ম ঢাকায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক

সমকাল: ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নিশ্চয় আপনি বিমানবন্দর ব্যবহার করেছেন। তাৎপর্যপূর্ণ কোনো পরিবর্তন দেখেছেন?

এম. নিয়াজ আসাদুল্লাহ: কাজের প্রয়োজনে আমাকে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরটি ঘন ঘন ব্যবহার করতে হয়। বিদেশ থেকে আগমন এবং প্রত্যাবর্তন– উভয় ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রকম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা আমার কাছে নতুন নয়; তা পোহাতে হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ভোগান্তির মাত্রা ও ব্যাপ্তি অনেক বেশি। এয়ারপোর্টে প্রবেশ, ইমিগ্রেশন, লাগেজ নিরাপত্তা ও নিরাপদভাবে বিমানবন্দর থেকে বহির্গমন–অতীতে সর্বক্ষেত্রেই হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এয়ারপোর্ট কর্মকর্তাদের অশোভন, অমানবিক আচরণ, কিছু না কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা প্রায়ই চোখে পড়ত। তবে এখন পরিবর্তন দৃশ্যমান। প্রবাসীদের বিমানবন্দরে ভিআইপি সেবা দেওয়ার যে ঘোষণা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল দিয়েছেন, তা আপাতত প্রতীকী হলেও গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আচরণে টেকসই পরিবর্তন আনতে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দৃষ্টি দিতে হবে এবং মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।

সমকাল: মানসিকতায় পরিবর্তন বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: কেবল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা নয়, জাতীয়ভাবেও প্রয়োজন মানসিকতায় পরিবর্তন। পোশাকশিল্প আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত বিবেচনায় সেখানে শ্রমবান্ধব কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত, আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স ও মান উন্নয়ন করতে সরকারি প্রচেষ্টার কমতি নেই। সে তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় উৎস সত্ত্বেও কিন্তু প্রবাসীকল্যাণ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রলাণয় দুটি বিভিন্নভাবে যেমন বিতর্কিত, ঠিক তেমনই এদের ব্যস্থাপনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবাসগামী শ্রমিকদের জন্য কোনো আস্থার জায়গা নয়। এদের প্রশ্রয়েই দশকের পর দশক চলছে দালালদের দৌরাত্ম্য, যার সঙ্গে আরও যুক্ত প্রবাসগামী শ্রমিকদের নিয়ে বিমান সিন্ডিকেটের টিকিট বাণিজ্য। সেই অর্থে বিমানবন্দরের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি জাতীয় পর্যায়ে প্রবাসী শ্রমিক বিষয়ে সরকারি নীতি ও সেবা প্রদানে কাঠামোগত দুর্বলতা ও সমন্বয়ের ঘাটতির এক রকম প্রতিফলন। এ সবকিছুর বিবেচনাতেই হয়তো বর্তমান সরকার প্রবাসীদের ভিআইপি মর্যাদা দেওয়ার কথা বলছে।

সমকাল: বিমানবন্দরে ভালো সেবার পাশাপাশি রেমিট্যান্স যোদ্ধা এ প্রবাসীদের যে অবদান, তার স্বীকৃতি সরকার আর কীভাবে দিতে পারে?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: অর্থনীতির ভিত্তির পাশাপাশি বৈদেশিক রেমিট্যান্স রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জুলাই বিপ্লবের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, রেমিট্যান্স বন্ধের হুমকি দিয়ে প্রবাসী জনগোষ্ঠী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মতো ঐতিহাসিক মুহূর্তে জাতীয় পর্যায়েও অবদান রাখতে পারে। তাদের স্বীকৃতি নিশ্চিত করার জন্য তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। এক. তাদের দেশে রেখে যাওয়া সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর মধ্যে এনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। দুই. তাদের বিনিয়োগকৃত ব্যবসায় উদ্যোগে কর মওকুফ করা এবং এ সব উদ্যোগ সফল করতে বাড়তি প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। তিন. প্রবাসে চাকরি ও মজুরি-সংক্রান্ত প্রতারণা ও নির্যাতন মোকাবিলায় আইনি সহযোগিতা এবং এ জন্য আমাদের দূতাবাসের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিধিমালা অনুযায়ী বিদ্যমান শ্রম আইন ও সামাজিক রক্ষাকবচগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা ।

সমকাল: প্রবাসীদের ডেটাবেজ করার দাবি উঠেছে ইতোমধ্যে। এটি কতটা জরুরি এবং সহজে কীভাবে করা যায়?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: প্রবাসীদের সঠিক নিবন্ধন ও তাদের পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি স্বচ্ছ ও সর্বজনীন ডেটাবেজ অত্যন্ত জরুরি। এর মাধ্যমে কোনো শ্রমিক বিপদে পড়লে বা প্রতারিত হলে তাঁকে দ্রুত শনাক্ত করা যাবে। একইভাবে দেশের উন্নয়নে প্রত্যাবর্তিত প্রবাসীদের কীভাবে কাজে লাগানো যায় সে­ সংক্রান্ত পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও ডেটাবেজ ব্যবহৃত হতে পারে। এটির ভিত্তিতে ইস্যু হতে পারে স্মার্টকার্ড, যেখানে সব ধরনের শনাক্তকরণ তথ্য থাকবে। প্রবাসে কর্মরত সময়ে নির্যাতনকারী মালিকপক্ষ কিংবা দালালরা শ্রমিকদের পাসপোর্ট নিয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে নিবন্ধিত শ্রমিকদের জন্য স্মার্টকার্ড কিছুটা আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।

সমকাল: আপনি দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন; মালয়েশিয়া সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার। ৩১ মে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কী?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: জনশক্তি আমদানি বন্ধের সাময়িক সিদ্ধান্তটি কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়; আরও ১৫ দেশের জন্য প্রযোজ্য। একটি কাঠামোগত সংকট মোকাবিলা করতেই এই সাময়িক নীতিগত পদক্ষেপ। এই সংকটের মূলে আছে জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদ– এই তিন গোষ্ঠীর একটি দুষ্টচক্র, যাকে বছর দু-এক আগে আমি ‘লৌহ ত্রিভুজ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলাম। জনশক্তি রপ্তানিকারক এশিয়ার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বেশ কিছু সরকার শক্তিশালীভাবে এই দুষ্ট চক্র দমন করলেও বাংলদেশের ক্ষেত্রে বিগত সরকারের আমলে ছিল না তেমন কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ। বরং সরকারি এমপি-মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্টতায় এই চক্র সীমাহীন দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়। দুদক ইতোমধ্যে বিগত সরকারের চার সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। এ বাস্তবতা বিবেচনায় মালয়েশিয়া সরকার তাদের বৈদেশিক শ্রমবাজারকে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে আনতে জনশক্তি/শ্রমিক আমদানির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেয়। এটিকে মালয়েশিয়া দেখছে একটি সম্পূর্ণ পুনরায় স্থানীয় শ্রমবাজার মুক্ত করার প্রস্তুতি। নীতিগতভাবে সামগ্রিক শ্রমবাজারের সংস্কার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের মাদানি ক্যাম্পেইনেরও একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সমকাল: মালয়েশিয়ার বন্ধ শ্রমবাজার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করার আশ্বাস দিয়েছেন সরকারের উপদেষ্টা। ইতালি অথবা চীনে কর্মীদের নতুন কর্মসংস্থানের কথাও তিনি বলেছেন। এ ক্ষেত্রে কী কী করা উচিত?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: ভবিষ্যতে যে দেশেই নতুন বাজার খুলতে চাই না কেন, তা হতে হবে কৌশলগত; সেই দেশের শ্রমিক চাহিদা যাচাই ও বিবেচনা সাপেক্ষে। যেমন ধরুন চীনের শ্রমবাজার। এখানে কর্মদক্ষতার পাশাপাশি প্রয়োজন চীনা ভাষা জ্ঞান। এই ভাষাগত নিশ্চিত সাপেক্ষেই চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় শ্রমচুক্তি টেকসই হবে। এ কৌশল বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন একটি ভবিষ্যৎমুখী জনশক্তি রপ্তানি ব্যবস্থাপনা, যেখানে নতুন বাজার সম্পর্কিত গবেষণা ও অভিজ্ঞতা সাপেক্ষে কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে।

সমকাল: বাংলাদেশে জনশক্তি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ১৩ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে অদক্ষ কর্মীই বেশি। এ সংকট কতটা সমস্যাজনক? দক্ষ শ্রমিক কীভাবে পাঠানো যায়?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: বৈশ্বিক শ্রমবাজারের ভবিষ্যৎ চাহিদা ও বর্তমান ঘাটতি বিবেচনায় আমাদের অদক্ষ কর্মীনির্ভর জনশক্তি রপ্তানির বর্তমান মডেল অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে টেকসই হবে না। যেসব উচ্চ আয়ের দেশে শ্রমের ব্যাপক ঘাটতি আছে, তারা অভিবাসন নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এবং কর্মসূচি চালু করেছে, যেমন কিনা ‘ভ্যালু-অ্যাডেড ইমিগ্রেশন প্রোগ্রাম’। অর্থাৎ তারা প্রাথমিকভাবে স্বল্প সময়ের জন্য শ্রমিক আনবে কিন্তু যোগ্যতা-নিশ্চিত সাপেক্ষে দীর্ঘমেয়াদে কাজ করার অনুমতি দেবে। এর মাধ্যমে তাদের নাগরিক-সমতুল্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। উন্নত দেশের বাইরে এশিয়ার উচ্চ আয়ের উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে শ্রম ঘাটতি আছে, তাদেরও শিল্পনীতিতে এসেছে নীতিগত পরিবর্তন। তারা বিদেশি শ্রমিক নিচ্ছে ‘হাই ভ্যালু-অ্যাডেড কমপ্লেক্স ইকোনমিক’ খাতে। এসব পরিবর্তন বিবেচনায় আজ বিশ্বব্যাপী দক্ষ কর্মীর চাহিদার ঊর্ধ্বগতি। বিএমইটি কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রদানের সর্বজনীন সুযোগ।

সমকাল: তার মানে, দক্ষ শ্রমিক তৈরির দিকেই আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: শ্রমবাজার ধরে রাখতে কিংবা নতুন বাজারে প্রবেশ করতে গেলে দক্ষ জনশক্তির কোনো বিকল্প নেই। লো ভ্যালু-অ্যাডেড থেকে হাই ভ্যালু-অ্যাডেড রপ্তানি খাতে উত্তরণের এ রকম লক্ষ্য আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের জন্যও সত্য। কিন্তু জনশক্তি খাতে নীতি, নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা– তিন ক্ষেত্রেই ঘাটতি। আগামী দিনগুলোতে এশিয়ার উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে কৃষি ও শিল্প; দুই খাতেই বিভিন্ন কর্মদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়বে। আসিয়ান অঞ্চলের শ্রমিকদের এ ধরনের দক্ষতা থাকায় ২০২২ সালে তারা অস্ট্রেলিয়ার কৃষি খাতে একটি আকর্ষণীয় স্কিমের জন্য বিবেচ্য হয়েছে। কানাডায় একই রকম সুযোগ আছে এবং আসবে।

সমকাল: আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও কি সেভাবে সমর্থন দিতে পারে?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের শিক্ষার মান সর্বজনীনভাবে নিম্ন। তাই শিক্ষার প্রসার সত্ত্বেও আজকে আমরা জাতীয় পর্যায়ে এক রকম ‘সাক্ষরতা বিপর্যয়’-এর মুখোমুখি। আমাদের কর্মবাজারে নতুন দক্ষতা অর্জন ও টেকসই করতে প্রয়োজন সম্পূরক সাক্ষরতা। এর একদিকে যেমন ব্যাপক ঘাটতি, অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষায় আমাদের নেই তৃতীয় ভাষা শেখার সুযোগ। ইংরেজি পাঠদানের বিধান থাকলেও মানের সংকটের কারণে সেখানেও নেই সুনির্দিষ্ট অর্জন। গ্রাম পর্যায়ে প্রাক-মাধ্যমিক শিক্ষার নাজুক অবস্থার মূল ভুক্তভোগী প্রবাসগামী শ্রমিক ভাইয়েরা। এ বিবেচনায় আমাদের দ্বিমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট ও বাজারমুখী কারিগরি প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার পাশাপাশি স্কুলশিক্ষা পর্যায়ে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কর্মবাজারে আমাদের শ্রমিকরা বাংলাদেশকে একটি দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত করতে পারে ।

সমকাল: এ ক্ষেত্রে আমাদের কারিগরি শিক্ষায় জোর কি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: কারিগরি শিক্ষা নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু এ শিক্ষা এখনও জনপ্রিয় হয়নি, উপরন্তু নানা সমস্যায় জর্জরিত। হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রিসহ বিশ্বের অনেক সেবা এবং শিল্প খাতে আমাদের কারিগরি গ্র্যাজুয়েটরা অবদান রাখতে পারত। অপরিকল্পিত প্রসার এবং নিম্নমান– এ দুই কারণে আমরা পরিচিত হতে পারিনি কারিগরি গ্র্যাজুয়েট রপ্তানির দেশ হিসেবে। জার্মানি যেখানে উচ্চমানের কারিগরি শিক্ষিত কর্মী দিয়ে শিল্প খাতের ব্যাপক অর্জন টেকসই করেছে, আমাদের কারিগরি শিক্ষা না পারছে দেশের চাহিদা মেটাতে, না পারছে বিদেশে শ্রম রপ্তানি করতে। একইভাবে আমরা ব্যর্থ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে মাদ্রাসা শিক্ষিত, আরবি ভাষায় দক্ষ গ্র্যাজুয়েট রপ্তানি করতে।

সমকাল: দেশে উচ্চ বেকারত্ব সত্ত্বেও এ কারণেই কি বিদেশ থেকে কর্মী এনে কাজ করাতে হচ্ছে?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: ভারত কিংবা অন্যান্য দেশ থেকে যারা আমাদের পোশাক শিল্পে কাজ করছে, তারা ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে নিয়োগপ্রাপ্ত। এক অর্থে এটা আমাদের ব্যবসায় প্রশাসন শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা। এত বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রিধারী ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট থাকা সত্ত্বেও কেন আমাদের পোশাকশিল্প খাত ভারতীয় ব্যবস্থাপকনির্ভর? এত বিজনেস স্কুলের ভূমিকা কি? আমাদের বিশ্বমানের পোশাক খাত আছে। অথচ কেন আমরা সর্বজনীন মানের প্রশাসনে দক্ষ কর্মশক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ?

সমকাল: হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ হচ্ছে না কেন?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: হুন্ডিকে আমি শ্যাডো মার্কেট বা ছায়া বাজার হিসেবে দেখি। হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর কারণ কয়েকটা হতে পারে। একটা হলো সরকারি অফিসিয়াল চ্যানেল আকর্ষণীয় না হওয়া, সরকারের প্রতি আস্থা না থাকা। তা ছাড়া পাঠানো অর্থ কতটা পরিবার পাবে। অর্থাৎ ট্রানজেকশন খরচ বেশি হওয়া। এর সঙ্গে শিক্ষার অভাবও যোগ করতে হবে। মানে, অফিসিয়াল চ্যানেলে যে দেশের উপকার হয়– এ বিষয়টা তাদের বোঝানো। আবার যারা অবৈধভাবে বিদেশ যায়, তারা হুন্ডিতে অর্থ পাঠানোকেই নিরাপদ মনে করে। কারণ অফিসিয়াল চ্যানেলে পাঠালে তার ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকে। সে জন্য হুন্ডিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে হবে না। অর্থাৎ জনশক্তি রপ্তানির অবৈধ চ্যানেল বন্ধ না করলে হুন্ডি বন্ধ হবে না। আরেকটা হলো, আমাদের টাকা পাচারের যে মাধ্যম, সেটিও হুন্ডি। মানব পাচারের রাজনৈতিক দুষ্টচক্র বন্ধ করাও জরুরি। রেমিট্যান্সে কর মওকুফসহ অল্প খরচে দ্রুত অর্থ পাঠানোর ব্যবস্থা করলে হুন্ডি প্রবণতা বন্ধ হবে।

সমকাল: দেশের বাইরে আমাদের একটা অংশ উচ্চশিক্ষিত। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়সহ উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন খাতে নিযুক্ত। তাদের কাজে লাগানোর উপায় কী?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: আমাদের একটা গ্লোবাল ট্যালেন্টপুল আছে। তাদের নিয়েও সরকারের করণীয় আছে। দেশে বিভিন্ন খাতে তাদের শিক্ষা ও দক্ষতা কাজে লাগানো যায়। মাইগ্রেন্ট এন্টারপ্রেনিউরশিপ বলে একটা কথা আছে। অর্থাৎ প্রবাসীদের দেশে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজে লাগানো। যেমন আপনি যাচ্ছেন কর্মী হিসেবে, বেরুচ্ছেন উদ্যোক্তা হয়ে। অর্থাৎ বিদেশি শ্রমবাজারে কর্মী হিসেবে ঢুকছেন, দেশে এসে হলেন উদ্যোক্তা। এমন সুযোগ পেলে শ্রমিকরাও উজ্জীবিত হতে পারেন।

সমকাল: প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বর্তমান সরকারের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ?

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: সরকার প্রবাসীদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিমানবন্দরে পরিবর্তনের সূচনাও দৃশ্যমান। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়েও প্রবাসীদের অবদানের কথা বলেছেন। আগামী দিনের বৈশ্বিক চাহিদার আলোকে শ্রমবাজার গড়তে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। ইতোমধ্যে অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে যে অপরাধ ও দুর্নীতি হয়েছে, তার উন্মোচন জরুরি। সে জন্য সরকার অর্থনীতির যে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে, সেখানে একজন শ্রমবাজার-সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

নিয়াজ আসাদুল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।

সমকালে প্রকাশ: ১ অক্টোবর ২০২৪

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।