
আগস্টে অনুষ্ঠিত প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে ডাক পেয়েছিল জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা)। সে হিসেবে দ্বিতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের সংলাপেও ডাক পাওয়ার প্রত্যাশা দলটির জন্য অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু জাতীয় পার্টির সে আশার গুড়ে সম্ভবত বালি পড়তে চলেছে। গত ৫ অক্টোবর তৃতীয় দফার প্রথম ভাগের সংলাপে বিএনপিসহ আটটি দল ও জোট আমন্ত্রণ পেলেও জাপা আমন্ত্রণ পায়নি। এমনকি এ দফার দ্বিতীয় ভাগে আগামী ১৯ অক্টোবর যে দলগুলো সংলাপের আমন্ত্রণ পেতে যাচ্ছে বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সেগুলোর মধ্যে জাপা নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ গত সপ্তাহে তাঁর এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হলে আমরা সেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও কঠোর বিরোধিতা করব।’ আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম প্রায় একই সময়ে লিখেছেন, ‘জাতীয় পার্টির মতো মেরুদণ্ডহীন ফ্যাসিস্টের দালালদের প্রধান উপদেষ্টা কীভাবে আলোচনায় ডাকেন?’ অনেকে বলছেন, এই দুই সমন্বয়কের অবস্থানের কারণেই জাতীয় পার্টির কপাল পুড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটেই জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের সম্প্রতি বলেছেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের সংলাপে না ডাকায় আমরা বিব্রত’। তিনি আরও বলেছেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ের আলোচনায় না ডাকা হলেও আপত্তি নেই। তবে আমাদের নিয়ে বাইরে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।’
কিন্তু মানুষ কী ভাবছে? জি এম কাদেরের খেদোক্তিসংক্রান্ত খবরটি রোববার সকালে সমকালের ফেসবুক পেজ শেয়ার করে। সোমবার সকাল পর্যন্ত ৬৯ হাজার মানুষ লাইক দিয়েছে। কমেন্ট করেছে ১৬ হাজার; শেয়ার করেছে প্রায় এক হাজার মানুষ। অধিকাংশ মানুষ নেতিবাচক মত দিয়েছে। বর্তমানে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোও জাতীয় পার্টির বিচার দাবি করে বলেছে, জাতীয় পার্টি সহযোগিতা না করলে এত দিন স্বৈরশাসন টিকে থাকত না।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে জন্ম নেওয়া জাতীয় পার্টির অধিকাংশ সময় কেটেছে ক্ষমতার সুবিধাভোগী হিসেবে। সে সুবিধা পাওয়ার জন্য দলটির নেতারা যে অনেক কিছুই করতে পারেন– ইতোমধ্যে তা প্রমাণিত।
জাতীয় পার্টি গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সহযোগী হয়ে ক্ষমতার মধু ভোগ করে। ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে সমালোচিত হলেও প্রতিটি নির্বাচনেই নানা টালবাহানা করে শেষ পর্যন্ত ভোটে অংশ নেয় দলটি। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলকে ভোটের বাইরে রেখে আওয়ামী লীগ যে স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাতে জাতীয় পার্টিই ছিল সহায়ক। জাতীয় পার্টির এমন সমর্থন না পেলে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। মানুষ এই দীর্ঘ সময়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে ছিল দমনপীড়নের উপলক্ষ, সেখানে জাতীয় পার্টি ছিল ক্ষমতাসীনদের জনগণের সম্পদ অবৈধ উপায়ে ভাগ-বাটোয়ারার অংশীদার।
এ বছরের শুরুতে যে নির্বাচন হয়, তা পরিহারে অন্য বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলে জাতীয় পার্টির ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা ছিল। অথচ দলটি কিছু আসন পেতে আওয়ামী লীগের করুণাপ্রাপ্তির পথই বেছে নেয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় ২৬টি আসনের ভাগ পেলেও দলটি নির্বাচনে মাত্র ১১টি আসন পায়।
জুলাইয়ে ছাত্রদের আন্দোলনে জাতীয় পার্টি সমর্থন দিয়েছে– এটা ঠিক। তবে আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সংসদ থেকে তাদের এমপিদের পদত্যাগ করার গুঞ্জন থাকলেও তা তারা করেননি– এটাও সত্য। একদিকে জি এম কাদের ৭ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের সমালোচনা করেছেন, অন্যদিকে মাত্র ১১ আসন নিয়ে সরকারের কৃপায় মন্ত্রীর মর্যাদায় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছেন। মূলত রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগের লিপ্সাই যে তাঁকে এহেন দ্বিচারী করেছে– তা বুঝতে কি গভীর কোনো জ্ঞান থাকা আবশ্যক?
জি এম কাদের অবশ্য এসবের একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেছেন, বিগত সরকার তাদের জোর করেছে। তা শুনে কেউ যদি ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যে নায়কের শত্রুর পরিচয় সম্পর্কিত ভুল ভাঙার পর লেখকের সেই খেদোক্তি স্মরণ করেন, তাহলে তাঁকে ভুল বলা যাবে না। সেখানে লেখক বলেছিলেন, ‘‘এতক্ষণে,’ অরিন্দম কহিলা বিষাদে’’। এর অনুসরণে কেউ বলতেই পারেন, ‘এতক্ষণে’ জাতীয় পার্টি ‘কহিলা বিষাদে’।
আগেই বলেছি, সুবিধাবাদী চরিত্রের জাতীয় পার্টি ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে। তা ছাড়া বহু ক্ষয়ের পরও অন্তত রংপুর অঞ্চলে প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের কারণে দলটির কিছুটা হলেও প্রভাব থাকতে পারে। সে জন্য অদূর ভবিষ্যতে ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলগুলোর মধ্যে এগিয়ে থাকা বিএনপির সঙ্গে জাপার সখ্য গড়ে উঠলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব এখন অনেকটাই স্পষ্ট। এ অবস্থায় সামনের নির্বাচনী অংক সহজ করতে বিএনপিও জাতীয় পার্টিকে কাছে টেনে নিতে পারে। যদিও বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টির সমালোচনা করছেন, তার পরও বিএনপি দলটির প্রতি নমনীয় হবে বলে অনেকের ধারণা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সবাই যখন নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান গড়তে ব্যস্ত, তখন জাতীয় পার্টিকে অতীতের ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে। তারপরও ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে দলটি নতুন করে রাজনীতি করতে পারে। প্রশ্ন হলো, বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধলে কি তা জাতীয় পার্টির জন্য সঠিক রাজনীতি হবে? যদি তা বিগত আমলের ধারা মেনে হয় তাহলে তা দলটির জন্য আদৌ ভালো হবে না– একথা বলাই যায়। উপরন্তু উভয়ের ভোট ব্যাঙ্ক বিশেষত আদর্শগত কারণে প্রায় একই চরিত্রের বলে আখেরে তা জাপার জন্য ভালো নাও হতে পারে। তোলা দুধে যে ‘পোলা’ বাঁচে না– অন্তত এ কথাটি দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে।