সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকতে পারে। কিন্তু এ আন্দোলনকে বল প্রয়োগে দমনের চেষ্টা অবশ্যই নিন্দনীয়। তার ওপর এ সপ্তাহের শুরুতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দিয়েছে। আটক ১৩ জন অবশ্য জামিন পেয়েছেন। এটা স্পষ্ট, আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিংবা তারা পাস করে বেরিয়ে চাকরিপ্রত্যাশী। আন্দোলন করা যেখানে তাদের সাংবিধানিক অধিকার, সেখানে তাদের সঙ্গে নির্দয় আচরণ কেন?
দীর্ঘদিনের এ আন্দোলন নতুন করে ভিন্ন মাত্রা পায় শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে চিঠি পাঠিয়েছেন তিন। স্বাভাবিকভাবেই চাকরিপ্রত্যাশীরা ভেবেছিলেন, শিক্ষামন্ত্রী যেহেতু এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন, তাদের বহু দিনের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীর ওই সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হবে বলে ৫ মে জানিয়েছিলেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী। যদিও পরদিন সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আপাতত বয়সসীমা বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত সরকারের নেই। আগামীতে বাড়াব কি বাড়াব না, বাড়ালে ভালো হবে কিনা– এটা আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। বিষয়টি আরও আলোচনা-পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে দেখব; তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’ জনপ্রশাসনমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর শিক্ষামন্ত্রীও তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেন। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, বয়স বাড়ানো সংক্রান্ত তাঁর ছিল জনপ্রতিনিধি হিসেবে ব্যক্তিগত দাবি। সেটা দাপ্তরিকভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ নয়।
শিক্ষামন্ত্রী জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনস্বার্থে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু জনপ্রশাসনমন্ত্রীর বক্তব্যের পর তিনি যেভাবে বললেন, তাঁর সুপারিশপত্রকে পুঁজি করে অনেকে জল ঘোলা করার চেষ্টা করছে– সেটি অপ্রত্যাশিত। যে কেউ তাদের দাবি জানালে সেটা গ্রহণ করা-না করার সিদ্ধান্ত সরকারের। তাই বলে কোনো অবস্থায়ই আন্দোলনকারীদের হেনস্তা কাম্য নয়। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের আগের দিনই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীরা শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশ করে গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেন। পরে পুলিশ জাতীয় জাদুঘরের দক্ষিণ পাশে তাদের বাধা দেয়।
পুলিশের সঙ্গে তাদের বাগ্বিতণ্ডা হতেই পারে। কিন্তু এ আন্দোলন মূলত অহিংস। যদিও মামলা দেওয়ার কারণ হিসেবে পুলিশ জীবননাশকারী পদার্থ দাহ্য জ্বালানি বহনের অভিযোগ এনেছে। শিক্ষার্থীদের এমন নিরীহ আন্দোলনে দাহ্য পদার্থ বহনের যৌক্তিকতা কী? যে আন্দোলকারীরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করছেন; চাকরির সুযোগ অবারিত করার জন্য আন্দোলন করছেন; স্বাভাবিকভাবেই তাদের ফৌজদারি অপরাধ করার কথা নয়। কারণ সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা ফৌজদারি মামলা। মামলা থেকে খালাস পেলেও প্রার্থীকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। অথচ পুলিশ কিনা এ ঘটনায় চাকরিপ্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল!
চাকরির সুযোগ বাড়ানোর আন্দোলন করতে গিয়ে নিজেদের চাকরির পথ সংকুচিত হওয়ার ঘটনা এবারই দেখলাম। এর আগে চাকরি জাতীয়করণ করতে গিয়ে শিক্ষকের মৃত্যুর অঘটনও দেখা গেছে। অহিংস, যৌক্তিক আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চড়াও হওয়ার এমন উদাহরণ কম নেই। আন্দোলনকারীরা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনতে চান, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের আটকাবেন। শহরে যানজটসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, সে জন্য তাদের থামাতেই পারে। কিন্তু আটকাতে গিয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতি নির্দয় হতে হবে কেন? আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা দুঃখজনক। তাদের মামলা দেওয়া আরও বেদনাদায়ক।
আমার মতে, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা উন্মুক্ত থাকা উচিত। বিশ্বের অনেক দেশে চাকরিতে প্রবেশে বয়সের কোনো বাধা নেই। শিক্ষামন্ত্রী নিজেও তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, বিশ্বে ১৬২টি দেশে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা কমপক্ষে ৩৫ বছর। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও ৩৫ বছর এবং রাজ্যভেদে ৪৫ বছর পর্যন্ত। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু অনেক কম ছিল। তখন চাকরির বয়স বাড়িয়ে ২৭ থেকে ৩০ করা হয়। এখন গড় আয়ু ৭২ বছর। সেই বিবেচনায় চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ হতেই পারে। বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হলে এবং অবসরের বয়স সেভাবে বাড়ালে সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না। অন্যদিকে দেশের নাগরিকরা উপকৃত হবেন।
এটা সত্য, পিএসসির প্রতিবেদনে যেমনটা এসেছে, চাকরির জন্য তাদের সুপারিশকৃতদের উল্লেখযোগ্য প্রার্থীর বয়স ২৩ থেকে ২৫ বছর এবং সেই তুলনায় বেশি বয়সীদের চাকরির হার কম। এমনটা হতেই পারে। তাই বলে তাদের সুযোগ তো দাপ্তরিকভাবে বন্ধ হওয়া কাম্য নয়। চাকরিক্ষেত্রে বয়সের তুলনায় যোগ্যতাই প্রধান হওয়া উচিত। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যাদের সুযোগ হবে, তাদেরই চাকরি হবে। এখানে ৩৫ বছর পর্যন্ত সুযোগ দিলে কিছু মানুষের উপকার ছাড়া কারোরই ক্ষতি হওয়ার কথা নয়।
আমাদের বরং নজর দিতে হবে, কীভাবে তরুণদের কাজে লাগানো যায়। সে জন্য উচ্চশিক্ষা থেকে সব ধরনের সেশনজট কমিয়ে আনতে হবে; বিসিএসসহ সরকারি চাকরির দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করতে হবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি শূন্য আসন স্বচ্ছতার সঙ্গে পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ যেসব তরুণ উদ্যোক্তা হতে চায়, তাদের পথও মসৃণ করতে হবে।
তারুণ্য একটি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ। তারুণ্যের এ সময়টা দেশের কাজে লাগলে সবাই উপকৃত হবেন। সেটাই আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। অযথা তরুণদের আন্দোলন দমানো কোনো ভালো লক্ষণ নয়। বরং পুলিশ আন্দোলনকারীদের মামলা প্রত্যাহার করুক এবং জনস্বার্থে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার ক্ষেত্রে প্রশাসন দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক।