Mahfuzur Rahman Manik
উচ্চশিক্ষায় ভর্তি যেই লাউ সেই কদু!

গত বছর থেকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বিশেষ করে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তিতে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন আমরা দেখেছি। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু হয়। প্রথম বছরের অভিজ্ঞতায় নানা ধরনের সংকট সামনে এসেছে। এ বছর গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তির আবেদন ১৫ জুন থেকে শুরু হয়েছে। এ বছরও ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি প্রক্রিয়া কতটা প্রত্যাশিত মানের হবে। ফি'র খড়গ এবং দেশজুড়ে সংশ্নিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া- এ দুটি অস্বস্তি থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়াই গুচ্ছ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য। আমরা জানি, আগে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটিতে আলাদা আবেদন করতে হতো বলে সবাইকে আলাদা ফি দিতে হতো। গুচ্ছ ভর্তিতে আমরা ভেবেছিলাম সেই ফি'র বোঝা কমবে বুঝি। কিন্তু গত বছর ফি রাখা হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। এ নিয়ে সমালোচনা হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা কমানোর কথা বললেও বাস্তবে এবার তা বেড়েছে আরও ৩০০ টাকা। অর্থাৎ গুচ্ছভুক্ত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল আবেদনই করা লাগবে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে!

আমরা দেখছি, কেবল গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফি-ই বাড়েনি, একই সঙ্গে এ প্রক্রিয়ার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থাও তথৈবচ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর এক লাফে ৩৫০ টাকা আবেদন ফি বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও একই পথে হেঁটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসির পক্ষ থেকে ভর্তি পরীক্ষার ফি যৌক্তিক পর্যায়ে আনলে আয়ের ৪০ শতাংশ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে দেওয়ার কথা আছে, তা দিতে হবে না মর্মে আশ্বাস দেওয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেদিকে যায়নি। বলা বাহুল্য, আবেদন ফি বাড়ালে শিক্ষার্থীদের সমস্যা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্নিষ্টদের সুবিধা। ২০১৯ সালে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের খবরে আমরা দেখেছি, ওই বছর বিশ্ববিদ্যালয়টির ভর্তির আবেদন থেকে আয় হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খরচসহ অন্যান্য ব্যয়ের পরে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পকেটে গেছে ৮ কোটি টাকা। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা অবশ্য আমরা জানি না। তবে ফি বাড়ানোর উদ্দেশ্য যদি শিক্ষার্থীদের কল্যাণের চেয়ে শিক্ষকদের পকেট ভরার জন্য হয়, তা নিশ্চয়ই দুঃখজনক।

এটা স্বীকার করতেই হবে, উচ্চশিক্ষায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে গুচ্ছ পদ্ধতি দেশের সবচেয়ে বড় ভর্তি প্রক্রিয়া। প্রয়োজনের নিরিখেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তিনটি গুচ্ছে ভাগ করা হয়েছে। সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২২টি। আটটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি গুচ্ছ। তিনটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমন্বিত পরীক্ষা। কৃষি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে একেক বছর একেক বিশ্ববিদ্যালয় দায়িত্ব পালন করছে, এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। এ বছর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তিতে সিলেকশন পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। এটা বাদ দেওয়া জরুরি। বিগত বছরগুলোতে আসন সংখ্যা অনুযায়ী আবেদন করা ভর্তিচ্ছুদের তিন গুণ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসার সুযোগ পেতেন। সেটা একটা বৈষম্যমূলক নীতি ছিল। গত বছর এ নিয়মের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা ব্যাপক প্রতিবাদ করেছিলেন। এ বছর কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হয়েছে।

গুচ্ছের মাধ্যমে ভর্তি চালুই করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য। সেখানে এর বিপরীত কোনো সিদ্ধান্ত কাম্য নয়। পাশাপাশি কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনাও প্রত্যাশিত নয়। যোগ্য শিক্ষার্থীরাই যাতে উচ্চ মাধ্যমিকের পর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পান, তাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। গত বছর সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নানা অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। যে কারণে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে, আবার কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন অপূর্ণ থাকার ঘটনাও ঘটেছে। অথচ আগে এমনটা চিন্তাই করা যেত না। সমকালের প্রতিবেদনেই আমরা দেখেছি, সপ্তম মেধাতালিকা প্রকাশের পরও আসন ফাঁকা রয়ে গেছে। এর পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবাস্তব চাহিদার দায়ও কম নয়। অর্থাৎ, ভালো ফল কিংবা বেশি স্কোরের শর্ত।

প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, ফি ও অন্যান্য বিষয় চিন্তা করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে নিজেদের মতো ভর্তির সময় নির্ধারণ করেছে, তা মোটেও যৌক্তিক নয়। যেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি কার্যক্রম শুরু হচ্ছে সেখানে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে ৩ জুলাই থেকে ক্লাস শুরুর ঘোষণা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে দিচ্ছে? আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি সবার শেষে হতো বলে শিক্ষার্থীরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নজর দিতেন। তাতে শিক্ষার্থীরা যেমন উপকৃত হতেন, তেমনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও লাভবান হতো। এখন তারা যেটা করছে, সে কারণে অনেক শিক্ষার্থী যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমনি অনেকের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির স্বপ্নও চূর্ণ হতে পারে। তা ছাড়া আমি মনে করি, এতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও সংকটে পড়বে। কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজাল্টের ভিত্তিতে ভর্তির কারণে ভালো ফলধারীরা স্বাভাবিকভাবেই ভর্তির সুযোগ পাবেন। তাঁরা ভর্তি হলেও পরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে ভর্তি বাতিল করলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন শূন্য থেকে যাবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক বছর ধরেই এভাবে ভর্তি নিচ্ছে। তারা স্ব্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। কিন্তু সেটা শিক্ষার্থীদের পক্ষে যাচ্ছে কিনা কিংবা তাঁদের জন্যও কল্যাণকর কিনা তা দেখা জরুরি।

ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। গতবারের মতো এবারও ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে দেশের আটটি বিভাগের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে। এটি ভালো সিদ্ধান্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার হলে ঘড়িসহ সব ইলেকট্রনিক বস্তু নেওয়া নিষেধ। কিন্তু ঘড়ি প্রতিটি রুমে থাকবে এটা স্বাভাবিক। অনেকে অভিযোগ করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক হলে ঘড়ি ছিল না। বিষয়টি ছোট হলেও জরুরি। কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে তা নজরে রাখবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন থাকে অনেকেরই; সেদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকটি বিষয়ের আসন কমানোর সিদ্ধান্ত অনেকেই ভালোভাবে নেননি।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা গরিব ও মেধাবীরাই বেশি সুযোগ পেয়ে আসছেন। তাঁদের জন্য একটি সুবিধাজনক ভর্তি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার স্বার্থেই অনেক বছর ধরে গুচ্ছ পদ্ধতির দাবি করেছেন অনেকেই। এখন সবাই না এলেও অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে গুচ্ছ ভর্তিতে এসেছে, তা স্বস্তিদায়ক। এ বিবেচনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সময়ও পরিবর্তন জরুরি। সব মিলিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে যে পরিবর্তন এসেছে, তা যথার্থই যেন শিক্ষার্থীবান্ধব হয়। অতীতের ভোগান্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এখন কেউ যেন বলতে না পারে- উচ্চশিক্ষায় ভর্তি যেই লাউ সেই কদু।

  • ছবি- ইন্টারনেট
ট্যাগঃ , , , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।