Mahfuzur Rahman Manik
তারুণ্যের নিদারুণ অপচয় এবং আমাদের অসহায়ত্ব
ফেব্রুয়ারী 13, 2024

সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ’। আমাদের তরুণদের বাস্তবতায় বলতে হয়, কী অসহায়ত্ব। পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন থেকে একটি দৈনিক তুলে ধরেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। তারা কাজ কিংবা শিক্ষা; কোনোটাতেই নেই। অথচ তাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। দুর্বার এই বয়সটা তরুণদের এভাবেই কেটে যাচ্ছে! কাজ কিংবা শিক্ষা ছাড়া তারা অসহায়। সমাজের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অংশ এবং দেশের বড় শক্তি তরুণদের কাজে না লাগানোর চেয়ে বড় অসহায়ত্ব আর কী হতে পারে! 

বলা হয়– অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। যে তরুণটির সময় শিক্ষায় ব্যয় হচ্ছে না; যে তরুণটি কাজে ব্যস্ত থাকছে না; তার মস্তিষ্ক অকাজে ব্যয় হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাদের বিষণ্ন হওয়া, বিপথে গিয়ে কিশোর গ্যাং গঠন করা কিংবা মাদকাসক্তির মতো সামাজিক অপরাধ ও পারিবারিক সহিংসতায় যুক্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। দিন দিন যে অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, এসব মোকাবিলায় গোড়ায় হাত দিতে হবে। তরুণদের কাজে লাগানোর বিষয়টি সামনে আনতে হবে।

প্রশ্ন হলো, তরুণরা নিষ্ক্রিয় কেন? ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সটা বলা চলে শিক্ষার। অবশ্য কারও যদি শিক্ষাজীবনে ছেদ না পড়ে, ২৪ বছরের মধ্যেই তার স্নাতকোত্তর বা উচ্চশিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কারও এর আগেও যেমন শেষ হতে পারে, তেমনি পরেও। এর অর্থ হলো, নিষ্ক্রিয় তরুণ প্রায় সবাই নানা পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া।
প্রতিবছর আনুমানিক ৪০ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শুরু করে। এসএসসি পর্যন্ত তার অর্ধেক সংখ্যকই ঝরে যায়। যেমন এ বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি পরীক্ষায় ২০ লাখ ২৪ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। যা হোক, শিক্ষা থেকে মাঝপথে ঝরে পড়াই মূলত এই ৪১ শতাংশ। এদের কাজে লাগাতে কারিগরি শিক্ষায় জোর দেওয়া দরকার।

আমাদের অসহায়ত্ব শুধু এই ৪১ শতাংশের জন্য নয়। অন্য তরুণরাই বা কতটা উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত? এমনকি শিক্ষা অর্জনের সময় এবং এর পর চাকরি খুঁজতে গিয়েও তারুণ্যের নিদারুণ অপচয় ঘটে। পাবলিক কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তরুণদের যে বড় অংশ ভর্তি হয়, তাদের কত অংশ নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়? কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছেন, তাদের কত শতাংশ একাডেমিক পড়াশোনাসহ উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত? 

চাকরির বাজারের অনিশ্চয়তার কারণে তরুণ অধিকাংশই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে চাকরির প্রস্তুতি শুরু করেন। গ্রন্থাগারগুলো শিক্ষার্থীর পরিবর্তে চাকরিপ্রার্থীর পদচারণায় মুখরিত। সরকারি চাকরি কিংবা বিসিএস হুজুগে তারা ৩০ বছর পর্যন্ত এই প্রস্তুতিতেই নিমগ্ন। অনেকের পাঁচ-ছয়বার পর্যন্ত চেষ্টায় বিসিএস হয়। কারও বয়স শেষ হয়ে গেলেও বিসিএস ধরা দেয় না। কারণ এই সোনার হরিণ সবার ভাগ্যে জোটে না। চার লক্ষাধিক চাকরিপ্রার্থী বিসিএসের জন্য আবেদন করেন; শেষ পর্যন্ত দুই থেকে তিন হাজার ক্যাডার হন। অথচ অধিকাংশই তো তারুণ্যের মূল্যবান সময় ব্যয় করে এই চাকরির চেষ্টা করে আসছেন। আমাদের অসহায়ত্ব এখানেও। বিসিএস কিংবা সরকারি চাকরির পেছনে যে তরুণরা সময় ব্যয় করছেন, সেই চাকরি খুবই সীমিত।

এদিকে বেসরকারি খাতে যথেষ্ট দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে না চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসাবে বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের চিত্রে দেখা যাচ্ছে, সরকারি চাকুরে মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এর বাইরে বেসরকারি চাকুরে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। যেসব খাতে বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং যেসব খাত সম্ভাবনাময় সেগুলোকে টার্গেট করে আমাদের তরুণদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তারা দেশে যেমন কাজে লাগতে পারেন, তেমনি বিদেশেও প্রশিক্ষিত কর্মী হিসেবে উচ্চ বেতনে চাকরি করতে পারেন। 

বাস্তবতা হলো, দেশীয় দক্ষ জনশক্তির অভাবে বিভিন্ন খাতে এখন বিদেশি কর্মীরা কাজ করছেন। দক্ষ জনশক্তি, বিশেষ করে শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপকের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১২৮ বিদেশির ওয়ার্ক পারমিটে অনুমোদন দেয়। এটি আগের বছরের তুলনায় ৮৭ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। কয়েক বছর আগে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছিল, প্রায় পাঁচ লাখ বিদেশি কর্মী বাংলাদেশে কাজ করেন। উচ্চ বেতনে কাজ করা এসব বিদেশি কর্মী বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন। এখানেই আমরা অসহায়। 
দেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি এবং মোট বেকারের চারজনের একজন উচ্চশিক্ষিত। বেকার এবং কাজ ও শিক্ষার বাইরে থাকা তরুণদের নিয়ে ভাবনাটা জরুরি। তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে দক্ষ তরুণদের কাজের ক্ষেত্র কম নয়। দক্ষতা থাকলে দেশে এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বিদেশেও কাজ করা সম্ভব। এসব সম্ভাবনা কীভাবে পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবতেই হবে। 

আমাদের অসহায়ত্ব এখানেও যে, যেসব তরুণ উদ্যোক্তা হতে চান, তারা সূচনাতে খুব একটা সহযোগিতা পান না। একদিকে সামাজিক নেতিবাচক মনোভাব, অন্যদিকে ঋণসহ নানা ক্ষেত্রে তাদের জটিলতায় পড়তে হয়। আমাদের তরুণরা নিঃসন্দেহে সম্ভাবনাময়। তারুণ্যের শক্তি কাজে লাগালে তারা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি দেশও দীর্ঘ মেয়াদে লাভবান হবে। আমাদের উন্নয়নের পরবর্তী গল্পটা তাদের নিয়েই হোক।

সমকালে প্রকাশ: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।