Mahfuzur Rahman Manik
ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় এরদোয়ানের ভূমিকা
জানুয়ারী 4, 2024

বোরহানউদ্দিন দুরান

ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান সম্প্রতি কাতার সফর করেছেন। সেখানে তিনি কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। তুরস্ক-কাতারের উচ্চ পর্যায়ের কৌশলগত বৈঠক ছাড়াও তিনি উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা জিসিসির সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। এর আগের কমিটির বৈঠকে ৮৭টি চুক্তি সম্পন্ন করার পর এরদোয়ানের এবারের সফরে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে আরও চুক্তি হয়। এবারের সফরে তুরস্কের মন্ত্রিসভার ছয় সদস্য অংশ নিয়েছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালের সংকটের সময় কাতারের পক্ষে ছিল তুরস্ক। এতে আঞ্চলিক দিক থেকে উভয় দেশের সম্পর্ক ‘কৌশলগত’ স্তরে উন্নীত হয়। তুরস্ক ও কাতার পরবর্তী সময়ে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা করে। এর পর তাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই আল থানির সঙ্গে এরদোয়ানের এবারের বৈঠকে আলোচনার শীর্ষ বিষয় ছিল গাজা পরিস্থিতি। জিসিসির সম্মেলনেও বিষয়টি গুরুত্ব পায়, যেখানে তুরস্ক ছিল কৌশলগত আলোচনার অংশীদার। তুরস্ক ও কাতার ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে আসছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতিতে কাতার সফলভাবে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধবিরতিসহ দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধ বন্ধে ইসরায়েলকে রাজি করাতে তুরস্ক সক্রিয়ভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

১১ নভেম্বর সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ওআইসি ও আরব লিগের যৌথ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তুরস্ক, ফিলিস্তিন, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, জর্ডান, কাতার ও নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজা যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং স্থায়ী শান্তি আনার জন্য আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে একমত হন। দুবাই থেকে ফেরার ফ্লাইটে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা অন্যদের বলেছি দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের বিষয়কে গুরুত্ব দিতে এবং সমাধানের বিষয় ছাড়া গাজা নিয়ে আলোচনা না করতে। আমরা দেখেছি, ইউরোপের কয়েকটি দেশ আমাদের অবস্থান বুঝতে পেরেছে এবং আমাদের যৌথ চাপের কারণে তারা যুক্তিগুলো অনুধাবন করতে শুরু করেছে।’ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘এ অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব সমস্যার সমাধান কর’র নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত ওআইসির সদস্যরা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে, তা ‘কৌশলগত বড় অর্জন’। এ বিষয় নিয়ে তুরস্ক দীর্ঘদিন কাজ করে আসছে এবং এ নীতিতে সবাইকে একমত করার চেষ্টা করছে।
সাময়িক যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল এরই মধ্যে ১২ শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। তারা বোমা হামলা আরও জোরদার করেছে। অবশ্য স্থল অভিযানে ইসরায়েলের অনেকে হতাহত হয়েছে। পশ্চিমারা যেভাবে ইসরায়েলকে ‘নিঃশর্ত সমর্থন’ দিয়েছিল, তাও শেষ হতে চলেছে। যুদ্ধ শেষ করার ব্যাপারে ইসরায়েলের কৌশল নিয়ে পশ্চিমা সরকারগুলো উদ্বিগ্ন। লড়াইকে দীর্ঘায়িত না করার জন্য তারা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারকে চাপ দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো, বেসামরিক মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে পশ্চিমা জনগণের গণবিক্ষোভ ও কঠোর প্রতিক্রিয়া। দ্বিতীয় কারণ হলো, সাত দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দল বৈঠকের মাধ্যমে যে যুক্তি পেশ করেছে, তার প্রভাবও এখানে রয়েছে। তা ছাড়া এটিও স্পষ্ট যে, ইসরায়েল গাজাবাসীকে হত্যা করা বা নিজেদের ভূখণ্ড থেকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়া ছাড়া কোনো সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

অনেক মাস বা বছর ধরে গাজা সংঘর্ষ লেগে থাকুক– এমনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সরকারগুলো চায় না। কারণ, এমন অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যে উগ্রবাদের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে এবং শক্তিধরদের প্রতিযোগিতায় রাশিয়া ও চীন তা নিয়ে খেলতে পারে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারাও বড় সংকটের কারণ। তারা হামাস নেতাদের নিশানা করা এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে আরও আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করার বিষয়ে কথা বলে। সে জন্য এখন পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা গাজা বিষয়ে ইসরায়েলি নীতির সমালোচনা করছে। নিচের উদাহরণ তাই প্রমাণ করে– ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ দুবাইয়ে জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন তথা কপ২৮-এ অংশ নিতে এসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, হামাসকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা অসম্ভব এবং ইসরায়েল যদি এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, তবে দেশটিকে এক দশক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। ইসরায়েল আত্মরক্ষা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার অধিকারের অজুহাতে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করতে পারে না। পশ্চিমারাও বিষয়টি মেনে নেবে না। দ্বিতীয়ত, ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিত রেগান ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোরামের সভায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন নিম্নলিখিত বিবৃতি দেন, ‘এ ধরনের লড়াইয়ে প্রধান কেন্দ্র হলো বেসামরিক মানুষ। আপনি যদি শত্রুর অস্ত্র তাদের ওপর চালান, তার মানে আপনার কৌশলগত জয় কৌশলগত পরাজয়ে রূপান্তরিত হলো।’

এ ধরনের পরোক্ষ ও কৌশলগত বিবৃতি যে ইসরায়েলকে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে বোমাবর্ষণ থেকে বিরত রাখতে পারবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা বন্ধে ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমাদের মিনমিনে কণ্ঠ আসলে ভণ্ডামিপূর্ণ, ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক। এরদোয়ানের এ যুক্তিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নে, ‘জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও ইসরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে এমনকি তার নিজস্ব কর্মীদেরও রক্ষা করতে পারে না। জাতিসংঘের গৌরবান্বিত আদর্শ, কনভেনশন, ঘোষণা ও নীতিমালা যেগুলো ব্যক্তি, সংস্থা এবং দেশের নিরাপত্তার রক্ষাকবচ, সেগুলো যেন ইসরায়েলের জন্য অকেজো। নিপীড়ন সমর্থন করার মাধ্যমে বা নীরবতার মাধ্যমে ইসরায়েলকে যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, এর মাধ্যমে সেগুলো সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে গেছে।’

এখনও ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, গণবিক্ষোভ ও বয়কট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গাজার পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ার জন্য কপ২৮ জলবায়ু সম্মেলন, ওআইসির অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য জোটের সম্মেলন এবং জিসিসির ৪৪তম সম্মেলনে জোর তৎপরতা চালিয়েছেন। তিনি তাঁর এ প্রচেষ্টা আগামী দিনেও অব্যাহত রাখবেন।

বোরহানউদ্দিন দুরান: তুর্কি প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা ও বিদেশনীতি কাউন্সিলের সদস্য; ডেইলি সাবাহ থেকে ভাষান্তর

সমকালে প্রকাশ: ৭ ডিসেম্বর ২০২৩

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।