
কর্মজীবী মানুষের অফিস থেকে বাসায় ফেরা যেন প্রশান্তির নীড়ে ফেরা। কর্মব্যস্ত দিন শেষে স্বজনের সংস্পর্শে আসার অনুভূতি অসাধারণ। নির্দিষ্ট সময়ে সন্তান অপেক্ষা করে মা কিংবা বাবার জন্য। কর্মজীবী মা কিংবা বাবাও ব্যাকুল থাকেন সন্তানের জন্য। পছন্দের কোনো খাবার বা অন্য কিছু নিতে পারলে বাড়তি ভালো লাগা কাজ করে। গত ১০ জানুযারি ব্যাংকার দীপু সানাও অফিস থেকে ফিরছিলেন প্রিয় সন্তানের পছন্দের মুড়ির মোয়া নিয়ে। ৩ বছরের ছোট্ট ছেলেটিও হয়তো মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু মা আর বাসায় ফেরেননি। নির্মাণাধীন একটি ভবন থেকে অভিশপ্ত একটি ইট চিরদিনের জন্য তাঁর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেয়!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে দীপু সানার ওপর ইট পড়ার দৃশ্য আমরা দেখেছি। তিনি রাজধানীর মৌচাকে ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন। হঠাৎ ওপর থেকে পড়ে ইটটি। সেটি ঠিক ইট নয়, কংক্রিটের ব্লক। এই ব্লকটি কোনো বিল্ডিং থেকে, নাকি ফ্লাইওভার থেকে পড়েছে, এখনও পুলিশ তার কিনারা করতে পারেনি। ব্লকটি যেখান থেকেই পড়ুক; মর্মান্তিক এ ঘটনা প্রমাণ করছে– নাগরিক নিরাপত্তা এখানে কতটা ঠুনকো।
এর আগে ট্রেনে পুড়ে মানুষের অঙ্গার হওয়ার চিত্র আমরা দেখেছি। রাজধানীতে হয়তো কেউ কাজে আসছিলেন, কেউ বেড়াতে। কে জানত– তাদের লাশ হতে হবে! তাদের বার্ন ইউনিটে ঠাঁই হবে!
গত সপ্তাহে রাজধানীর সড়কে প্রাণ হারানো তামিমের কথাও বলা যায়। তিতুমীর কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের এ শিক্ষার্থী মোটরসাইকেলে বেরিয়েছিলেন। কুড়িল বিশ্বরোড ফ্লাইওভারে তাঁকে ট্রাকচাপা দিয়ে পালিয়ে যায় হন্তারক চালক। রাজধানীর আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যুর কথাও আমরা জানি। ২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারের আগুনে ২৭ জনের মৃত্যুর বড় অঘটন ছাড়াও অগ্নিকাণ্ড থেমে নেই। কেমিক্যালসমৃদ্ধ পুরান ঢাকায় উল্লেখযোগ্য অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনাও কম নয়।
এমন নানা মরণফাঁদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাজধানীতে। সারাবছর এখানে চলে উন্নয়নযজ্ঞ আর মানুষের ভবন নির্মাণ। কিন্তু পথচারী সুরক্ষা নিশ্চিত না করে এ কেমন নির্মাণ? ২০২২ সালের আগস্টে বিআরটি প্রকল্পে উত্তরার জসীম উদ্দীন মোড়ে ক্রেনচাপায় প্রাইভেটকারের পাঁচ যাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনাও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর পরও নির্মাণ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা বন্ধ হয়নি। দীপু সানার মৃত্যু ছাড়াও বাংলাদেশে প্রায়ই নির্মাণাধীন ভবনে শ্রমিক বা ভবন থেকে কিছু পড়ে পথচারীর মৃত্যুর খবর আলোচনায় আসে। ইট ছাড়াও ওপর থেকে ফুলের টব, রড ইত্যাদি পড়ে যেমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তেমনি ওপর থেকে না পড়লেও ম্যানহোলে পড়ে মৃত্যুর অঘটন ঘটেছে।
রাজধানীতে মাথায় ইট পড়ে মৃত্যুর পরিসংখ্যানই সবচেয়ে বড়। গত বছর মিরপুরের পল্লবীতে মাথায় ইট পড়ে এক যুবকের মৃত্যুর খবর প্রকাশ হয়। ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর সমকালের শেষ পৃষ্ঠায় ‘মাথার ওপর ইট পড়ে, কর্তৃপক্ষ নড়ে না’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেখানে কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে রাজধানীতে দুটি ঘটনা ঘটে, মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যান এলাকায় ইট পড়ে স্কুলছাত্রের মৃত্যু এবং মিরপুরে মেট্রোরেল স্টেশন থেকে ইট পড়ে পথচারীর মৃত্যু। আগের মৃত্যুর ঘটনাগুলো আলোচনায় না এলেও দীপু সানার মৃত্যুর বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। দীপু সানার সামাজিক অবস্থান এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি একাডেমিক দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এক বছরের বড় ছিলেন। সে জন্য ফেসবুকের অনেক বন্ধুই এ নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর তিনি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। গত বুধবার তাঁর কর্মস্থল সদরঘাটে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস থেকেই তিনি ফিরছিলেন। তাঁর প্রাণহানির এ ঘটনা স্বাভাবিকভাবে আমাদের নাড়া দিয়েছে।
দীপু সানার মৃত্যুর ঘটনাকে ‘হত্যাকাণ্ড’ আখ্যায়িত করে এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সহপাঠী ও সহকর্মীরা। তারা অবশ্য কেবল দীপু সানা হত্যার বিচার দাবি করেই থেমে যাননি; দাবি জানিয়েছেন বাসযোগ্য নগরীর; যাতে সবাই নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে। বাসযোগ্য ও নগরী নিরাপদ না হলে যে কেউ এর শিকার হতে পারে। রাজধানী ঢাকা নিয়ে অভিযোগ বিস্তর। এখানে একক কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। খেয়ালখুশিমতো যে যখন ইচ্ছা মাটির নিচে খোঁড়াখুঁড়ি করতে পারে; ওপরে ‘উন্নয়ন’ কাজ চালাতে পারে। এখানে গণপরিবহনের অবস্থা খুবই নাজুক। পরিবহনের পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় রাজীব হোসেনের হাত হারানো, এর পর তাঁর মৃত্যুর বেদনাদায়ক ঘটনা আমাদের পীড়া দেয়। বিশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থায় সড়কে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ন্ত্রণহীন।
দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। নিরাপদ সড়কের জন্য তাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি।
প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন লিখেছিলেন– ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। রাজধানীজুড়ে যেসব মৃত্যুকূপ আমরা দেখছি, তাতে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা আমাদের কে দেবে? আমাদের সর্বাঙ্গে ব্যথার মতো সংকট সর্বত্র। দীপু সানার প্রাণহানির ঘটনা শুধু আলোচনার মধ্যেই যেন শেষ না হয়। এ ঘটনায় কর্তৃপক্ষ অন্তত পথচারীর নিরাপত্তার বিষয়টি দিয়ে শুরু করুক। এ ব্যাপারে যে আইন আছে তা মানা হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকির মাধ্যমে এর সূচনা হতে পারে।