Mahfuzur Rahman Manik
বিশ্বনেতাদের অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে
ডিসেম্বর 11, 2023

বান কি মুন ও গার্সা ম্যাচেল

ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ডের বছরে বিশ্বনেতারা দুবাইয়ে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের ২৮তম সম্মেলনে মিলিত হতে চলেছেন। আমরা বৈশ্বিক উষ্ণতার এক অভূতপূর্ব যুগে প্রবেশ করেছি: ২০২৩ সালটি সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হওয়ার রেকর্ডের নিকটবর্তী। আমরা উত্তর আমেরিকায় চরম দাবানল দেখেছি।

আফ্রিকায় প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। চীন, দক্ষিণ ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড গড়া তাপপ্রবাহ দেখা গেছে। পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলসহ ভয়াবহ হারিকেন ও ঘূর্ণিঝড় দেখা গেছে সাম্প্রতিক সময়ে। এতে লিবিয়া, গ্রিস, তুরস্ক ও বুলগেরিয়ায় প্রায় ১০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং কমপক্ষে ২০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। সমুদ্রের তাপমাত্রাও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা প্রবালের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করেছে এবং সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রকে ওলটপালট করে ফেলছে।

বিজ্ঞান আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছে, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আবহাওয়ার নির্দয় আচরণ আরও বাড়বে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে এবং জলবায়ু সংকট যেভাবে তীব্র হচ্ছে; বিশ্বনেতাদের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা এখনও সেভাবে প্রস্তুত নই।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) সাম্প্রতিক প্রকাশিত অ্যাডাপটেশন গ্যাপ রিপোর্ট বা অভিযোজন শূন্যতা প্রতিবেদন ২০২৩-এ দেখানো হয়েছে, অর্থায়ন কতটা কম। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের অভিযোজনের অপ্রস্তুত অবস্থা দেখানো হয়েছে। অভিযোজনের মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে পারি এবং সহনশীলতা বা স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে পারি। কিন্তু সেই অভিযোজন কাজটা সব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বেশ ধীর। অথচ ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় এটি ত্বরান্বিত করা জরুরি।

এটি বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সত্য। তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো সম্পদ সবচেয়ে কম রয়েছে; অথচ বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য তাদের ভূমিকা খুবই নগণ্য। ইউএনইপির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজনীয় অভিযোজনের জন্য এই দশকে প্রতি বছর ২১৫ বিলিয়ন থেকে ৩৮৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।

অভিযোজনের জন্য বর্তমানে আন্তর্জাতিক যে অর্থায়ন রয়েছে, এটি তার চেয়ে ১০ থেকে ১৮ গুণ। আমরা দেখছি এ ক্ষেত্রে অর্থায়নে প্রতি বছর ১৯৪ বিলিয়ন থেকে ৩৬৬ বিলিয়ন ডলারের বিস্ময়কর ফারাক থেকে যাচ্ছে। বিশ্বনেতাদের অবিলম্বে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে।

কপ২৬-এ গ্লাসগোতে বিশ্বনেতারা একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছিলেন। সেই চুক্তি অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং স্থিতিস্থাপকতা তৈরিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দ্বিগুণ সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। উন্নত দেশগুলোকে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। অভিযোজন তৎপরতা ও বিনিয়োগের নির্দেশনা বাস্তবায়ন এবং অভিযোজন সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য পূরণে সবাইকে একটি উচ্চাভিলাষী কাঠামো গ্রহণ করতে হবে। আমরা নেতাদের প্রতি এই মুহূর্তটি কাজে লাগাতে এবং একটি দ্ব্যর্থহীন বার্তা পাঠাতে অনুরোধ করছি যে জলবায়ু সংকটের ক্রমবর্ধমান হুমকির বিরুদ্ধে জনগণ, অর্থনীতি ও বাস্তুতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের জরুরি ও অর্থপূর্ণ বিনিয়োগ প্রয়োজন।

এর সমাধান যে নেই, তা নয়। জাতিসংঘ মহাসচিব ইতোমধ্যে সতর্ক করেছেন, যেখানে তিনি ২০২৭ সালের মধ্যে বিপজ্জনক আবহাওয়া, পানি বা জলবায়ু সংকট তৈরির আগেই পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্য সমাধানের মধ্যে রয়েছে জলবায়ু অবহিত পরিকল্পনা ও উন্নয়ন; স্থিতিস্থাপক খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্য এবং অবকাঠামো ব্যবস্থা এবং দুর্যোগের সময় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। গুরুত্বপূর্ণ হলো, সংকট মোকাবিলার কাঠামোতে অবশ্যই শক্তিশালী, যথার্থ লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে, যাতে আমরা সবাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অগ্রগতিও চিহ্নিত করতে পারি। সে লক্ষ্যে অর্থ, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি স্থানান্তরকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে এটি আরেকটি ফাঁপা প্রতিশ্রুতি না হয়।

আমাদের নানামুখী বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যেও কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এখানে সংকট রয়েছে, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের কৃষকরা সংকটের মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছেন; তারা ধাক্কা সামলে নিচ্ছেন। এটা নিঃসন্দেহে গুরুতর অন্যায় যে জলবায়ু পরিবর্তনে যাদের ভূমিকা নেই, তারাই জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। তারা জলবায়ু অর্থ সহায়তাও যথার্থভাবে পাচ্ছে না। যা পাচ্ছে তা দুঃখজনকভাবে অপর্যাপ্ত।

২০ লাখেরও বেশি মানুষ ভরণ-পোষণ এবং জীবিকা নির্বাহে ক্ষুদ্র কৃষি খামারের ওপর নির্ভরশীল। তার পরও তাদের অভিযোজনে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু অর্থের ২ শতাংশেরও কম ব্যয় হয়। দ্রুত এই বৈষ্যমের সমাধান করতে হবে।

জলবায়ু সংকটে ভবিষ্যৎ খাদ্য ব্যবস্থায় যে বিপর্যয় আসছে, তা মোকাবিলায় উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে নারী নেতৃত্বাধীন ভূমিকা ও উদ্যোগ সংকটের সমাধান করতে পারে। কৃষি-খাদ্য খাতের রূপান্তর কার্যকর গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে এবং স্থানীয় চ্যালেঞ্জগুলোকে বৈশ্বিক সুযোগে পরিণত করে। তৃণমূলের উদ্ভাবকদের প্রয়োজনীয় সম্পদ, জ্ঞান ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে ক্ষমতায়িত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে দুর্বলতা শক্তিতে রূপান্তর হতে পারে।

মানবতা এখন গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে মূলধারায় ফিরে আসার সুযোগটি আমাদের নষ্ট করা উচিত নয়। আমরা আশা করব, কপ২৮-এ বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত সেই সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। তাদের সেসব অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে, যা এখন পর্যন্ত অপূর্ণ রয়ে গেছে।

বান কি মুন: জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠন দি এল্ডার্সের ডেপুটি চেয়ার এবং গার্সা ম্যাচেল: দি এল্ডার্সের ডেপুটি চেয়ার ও নারী-শিশু অধিকার কর্মী; দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর

সমকালে প্রকাশ: ১ ডিসেম্বর ২০২৩

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।