নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির নাটকের শেষ নেই। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের মতোই তাঁর ভাই জি এম কাদের ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাচ্ছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে বিএনপি না এলেও জাতীয় পার্টি এসেছে। যদিও গত বছরজুড়ে দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন– বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, সে কারণে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না। বক্তব্য যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে আসবেন– সেটি রাজনৈতিক বোদ্ধারা ভালো করেই জানতেন। অবশেষে এলেনও। এমনকি জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় ২৬টি আসনের ভাগ পেয়েছে। নতুন বছরের প্রথম দিন রংপুরে গণসংযোগকালে জি এম কাদের আবার বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত থাকবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তাঁর এ বক্তব্যের পেছনের কারণটা অনেকে বলছেন, সমঝোতার আসনগুলোতে যাতে অন্তত জয়টা নিশ্চিত হয়, সেই বার্তাই তিনি আওয়ামী লীগকে দিতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, জাতীয় পার্টির এই দৈন্যদশা কেন? তাকে কেন আসন নিশ্চিতে আওয়ামী লীগের করুণা পেতে হবে? যে কারণে এখন বিরোধী দল কে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। জাতীয় পার্টি যেহেতু নির্বাচনে এলো; দলটি একাই যদি নিজেদের সামর্থ্যের ওপর ভরসা করে সারাদেশে প্রার্থী দিত এবং আসন সমঝোতা না করে নিজেরাই নির্বাচন করত, তাদের আরও ভালো ফল করার সম্ভাবনা ছিল। অনেক জায়গাতেই সরকারবিরোধী ভোট জাতীয় পার্টি পেত। সেই সুযোগ জাতীয় পার্টি হারিয়েছে। ২৬ আসনে ভাগাভাগি ছাড়াও সারাদেশেই দলটি প্রার্থী দিয়েছে, এটি সত্য। কিন্তু যেভাবে জাতীয় পার্টি নির্বাচন করছে এবং ক্ষমতাসীনদের ওপর যেভাবে অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল, সেটিই সুযোগ হারানোর কারণ। তা না হলে, মানুষ হয়তো ক্ষমতাসীনদের বিকল্প হিসেবে বিএনপির অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টিকে ভোট দিত। এতে সারাদেশে জাতীয় পার্টির অনেক আসন লাভের সুযোগ ছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টি সে পথে হাঁটেনি।
জাতীয় পার্টি কেন এ সুযোগ হারাল? এর পেছনে অনেক কারণ থাকলেও রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে দুটি কারণ নিশ্চয় প্রধান হিসেবে ধরা দেবে। প্রথমটি হলো, একলা চলতে পারবে– এ আত্মবিশ্বাস দলটির নেই। আমরা দেখেছি, ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি অধিকাংশ সময়েই জোটগতভাবে রাজনীতি করে আসছে। এভাবে রাজনীতি করতে গিয়ে দলটি অন্য দলের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সে জন্য দলটির নেতাকর্মীর মধ্যে নির্ভরশীল মানসিকতা গড়ে উঠেছে। যে কারণে নির্দিষ্ট ভোট ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও দলটি তা কাজে লাগাতে পারছে না। তাদের এই মানসিকতার কারণে মানুষের উল্টো সমর্থন হারাচ্ছে। দ্বিতীয় কারণও প্রথম কারণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেহেতু জাতীয় পার্টি জোটের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু জোটের শক্তিশালী দল যেভাবে নাচায় তারা সেভাবেই নাচছে। গত দেড় দশক ধরে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংশ্রবেই আছে। এর মধ্যে গৃহপালিত বিরোধী দলসহ নানা তকমা পেয়েছে দলটি। একই সঙ্গে সরকার এবং বিরোধী দলে থাকার রেকর্ড করেছে দলটি।
দলটির নেতাদের নির্ভরশীল মানসিকতা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব এতটাই প্রকট, এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর লাঙ্গল প্রতীকের ব্যানার-পোস্টারে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহার করে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পোস্টারে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কথাও লেখা আছে। এর পরও দলটি নির্ভার নয়। সমঝোতার মাধ্যমে ২৬টি আসন পেলেও একটি সংবাদমাধ্যম বলছে, ১৬টিতেই জাতীয় পার্টি চিন্তিত। অর্থাৎ সমঝোতার অর্ধেকের বেশি আসনই হয়তো দলটি হারাতে যাচ্ছে। এর বাইরে বাকিগুলোর অবস্থা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না।
সমঝোতার আসনসহ সব মিলিয়ে জাতীয় পার্টি ২৮৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক খবর হলো, দলটির প্রার্থীরা বিভিন্ন আসনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। তাদের কয়েকটি আসনে লড়াইয়ের আভাস থাকলেও অধিকাংশ আসনেই দলটির তেমন প্রচার-প্রচারণা নেই। নির্বাচন থেকে যারা সরে দাঁড়াচ্ছেন তারা বলছেন, নির্বাচনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা শক্তিশালী। এমনকি প্রচার-প্রচারণার জন্য কেন্দ্র থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই যেখানে সংসদ সদস্য হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীরা স্বেচ্ছায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন, সেই দলের অবস্থা কতটা শোচনীয়– তাও স্পষ্ট। জি এম কাদের যদিও বলেছেন, ‘পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে আমার একটা নির্দেশ আছে, যারা নির্বাচন করতে চান, করতে পারেন। নির্বাচন করতে না চাইলে সেটিও সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে।’ তার মানে, ২৬টি আসনকেই তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। অন্যগুলো নামকাওয়াস্তে। এর কারণ সেই পরনির্ভরশীলতা
কিংবা ক্ষমতাসীনদের অঙ্গুলি হেলনে চলা। এর পরও যখন জাতীয় পার্টির ওপর শঙ্কা ভর করছে, তখন জি এম কাদের ওপরে ওপরে ক্ষমতাসীনদের ভয় দেখাচ্ছেন– ‘নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকব কিনা’। আর তলে তলে হয়তো সমঝোতা, যাতে ২৬টি আসন হাতছাড়া না হয়।
২৬টি আসন নিয়ে যে দল সন্তুষ্ট থাকতে চায়, তারা কীভাবে একাকী নির্বাচন করবে? যে দলের নিজস্বতা নেই; যে দলের নেতারা সকালে এক কথা বলেন, বিকেলে আরেক কথা, তাদের ওপর মানুষ কীভাবে ভাগ্যের উন্নয়নে নির্ভর করবে? সেই দলের ললাটে যে ভাঙনই অনিবার্য, তা এর আগে কয়েকটি নির্বাচনেই আমরা দেখেছি। বস্তুত এইচএম এরশাদ থাকতেই জাতীয় পার্টিতে এই সংকট শুরু হয়েছে। সকাল-বিকেল মত পাল্টানো এরশাদের বৈশিষ্ট্য দলটি এখনও ধরে রেখেছে। নিজেদের স্বার্থের এমন রাজনীতিতে শত সুযোগ আসা-যাওয়াতেই বা কী? এমন রাজনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখা কঠিন। এ অবস্থা চলতে থাকলে জাতীয় পার্টি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।