Mahfuzur Rahman Manik
জলমহালের নয়া জমিদার!
জুলাই 12, 2023

জলমহালের সাধারণ নীতি হলো– ‘জাল যার, জলা তার’। বাস্তবে জলমহাল যেভাবে চলছে সেটি হলো, ‘ক্ষমতা যার জলা তার।’ কাগজপত্র জেলের নামে হলেও ভোগ করছেন নেতারা। রোববার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদনে বগুড়ার অন্তত পাঁচটি জলমহালের চিত্র এসেছে, যেখানে মৎস্যজীবী সমিতির নামে জলমহাল থাকলেও স্থানীয় নেতা কিংবা প্রভাবশালীরা সেগুলো দখল করে আছেন। শুধু বগুড়া নয়; দেশের অন্যান্য জলমহালের অবস্থাও তথৈবচ। এমনকি উন্মুক্ত জলমহাল তথা আস্ত নদীও যে ব্যক্তির ভোগে থাকতে পারে– সেটি শুটকি নদী সংক্রান্ত সমকালেরই প্রতিবেদন থেকে আমরা জানি। ২২ মে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনমতে, আইনের প্যাঁচ দেখিয়ে ‘রাজা’ সাহেব নদীকে নিজেদের দাবি করছেন!

একবার চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং উকিল– তিনজন আলাপে বসেছেন। আলোচনার বিষয়– কার পেশা সবচেয়ে প্রাচীন? চিকিৎসক বললেন, পৃথিবীতে সবার আগে মানুষ এসেছে। আমরা মানুষের রোগ নিয়ে কাজ করি, তাই ডাক্তারিই আদি পেশা। প্রকৌশলীর যুক্তি, মানুষ আসার আগে নিশ্চয়ই তাদের ঘরবাড়ি বানাতে হয়েছে; তাহলে তো প্রকৌশল পেশাকেই প্রাচীন বলতে হবে। উকিল এবার নড়েচড়ে বসলেন। তিনি বললেন, মানুষ এলো; তার আগে বাড়ির দরকার হলো। কিন্তু বাড়ি বানানোর আগে তো মামলা-মোকদ্দমা করে মানুষকে জমির মালিক হতে হয়েছে, নাকি? তাহলে বলুন– কার পেশা আগে?

এর সূত্র ধরে আইনের লোকেরা বলতে পারেন, জলমহালের নামের মধ্যেই তো সমস্যা। কারণ মহাল মানে হলো, জমিদারের অংশ বা সম্পত্তি। সুতরাং জলমহাল জমিদাররা কিংবা প্রভাবশালীরা দখল করবে, তাতে সমস্যা কোথায়?
যা হোক, সরকার প্রণীত ‘সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি-২০০৯’ এ বলা আছে, কীভাবে জলমহাল ইজারা দেওয়া যাবে। নীতিমালা অনুসারে ‘কোনো সমিতিতে যদি এমন কোনো সদস্য থাকেন, যিনি প্রকৃত মৎস্যজীবী নন, তবে সে সমিতি কোনো সরকারি জলমহাল বন্দোবস্ত পাওয়ার যোগ্য হবে না।’ মৎস্যজীবী কারা? সেটাও নীতিমালায় আছে, ‘যিনি প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ শিকার এবং বিক্রয় করেই প্রধানত জীবিকা নির্বাহ করেন, তিনি প্রকৃত মৎস্যজীবী বলে গণ্য হবেন।’ অথচ সেই মৎস্যজীবীরাই জলমহাল পাচ্ছেন না।

বগুড়ার সোনাতলার সাতবিলা জলমহালের কথাই ধরা যাক। সেটি কাগজ-কলমে ইজারা নিচ্ছে মধুপুর ইউনিয়ন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। বাস্তবে সেটি ভোগদখল করছেন মধুপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর ইজারা গ্রহীতা হিসেবে মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি যে যুধিষ্ঠির চন্দ্রের নাম আছে, তিনি কিনা মজুরির ভিত্তিতে জলমহালটি দেখভাল করছেন মাত্র।
১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে দেশ থেকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও এখনও সেই জমিদারির কথা মনে করাচ্ছে জলমহালগুলো। এখনও যেভাবে ব্যক্তির নামে নদী থাকে; যেভাবে আবাসন কোম্পানিগুলো নিজেদের নামে জমির পর জমি দখল করে ব্যবসা করছে; সেখানেও যেন সেই জমিদারির ছাপ। জলমহালের ক্ষেত্রে তারপরও মন্ত্রী বলবেন– ‘জাল যার, জলা তার’। আসলেই তা হচ্ছে না কেন? সরকার কি চাইলে তা পারে না!

সমকালে প্রকাশিত: ৩ জুলাই ২০২৩

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।