রামজি বারুদ
ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক
সংখ্যা কখনও কখনও অমানবিক হতে পারে। তবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা সমস্যার স্বরূপ বুঝতে এবং জরুরি প্রশ্নের জবাব খুঁজতে সাহায্য করে। এমনকি অধিকৃত ফিলিস্তিন থেকে কেন বড় বিদ্রোহের জন্ম নিতে পারে এবং ইসরায়েল কেন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ দমন করতে পারে না?– এমন প্রশ্নেরও জবাব তা দিতে পারে। ইসরায়েল যতই সহিংস বা কঠোরভাবে চেষ্টা করুক; ব্যর্থ হয়েছে। সে জন্যই সংখ্যাটি প্রাসঙ্গিক। এ বছর ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজায় প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২৭টি শিশু রয়েছে। সর্বশেষ সোমবার ফিলিস্তিনের জেনিন ও রামাল্লায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে অন্তত ৯ জন। গাজা, জেনিন ও নেবলাসে ইসরায়েল সবচেয়ে বেশি সহিংসতা চালিয়েছে। সেখান থেকে ফিলিস্তিনিরা সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধও করেছে।
আশ্চর্যজনক, ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের অগ্রভাগে ভূমিকা পালন করেছে। এ কারণে জেনিন, বালাতা, আকাবাত জাবর, জাবালিয়া, নুসেইরাত এবং অন্যান্য শরণার্থী শিবির প্রতিরোধ কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। ইসরায়েল যত কঠোরভাবে এসব প্রতিরোধ দমনের চেষ্টা করেছে, ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন তত বড় আকারে প্রকাশ পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে জেনিনের কথা বলা যায়। ২০০২ সালে এপ্রিলে ইসরায়েলি গণহত্যার পর সেখানে শরণার্থী শিবিরে যে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়েছে, তা কখনও থামেনি। সব পর্যায়ে এই প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে। যদিও দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ বা ইন্তিফাদায় ইসরায়েলি আক্রমণের বিরুদ্ধে শিবির রক্ষাকারী যোদ্ধাদের অনেককে হত্যা বা কারারুদ্ধ করা হয়েছে। নতুন প্রজন্ম এখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার। জেনিনে ইসরায়েলের সামরিক হামলা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যে কারণে সেখানে হতাহতের ঘটনাও অনেক ঘটেছে। এর আগে এ বছরের ২৬ জানুয়ারি বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সে সময় ইসরায়েলি সেনারা শরণার্থী শিবিরে আক্রমণ করে ১০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে এবং এর দ্বিগুণের বেশি আহত হয়। ইসরায়েলি হামলা ঘন ঘন হওয়ায় ফিলিস্তিনি হত্যাও অব্যাহত থাকে। তবে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জেনিন ছাড়িয়ে নিকটস্থ অবৈধ ইহুদি বসতি এবং সামরিক চেক পয়েন্টেও ছড়িয়ে পড়েছে। এটি খুবই সাধারণ বিষয় যে, ইসরায়েলি সৈন্য ও নতুন বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে যেসব ফিলিস্তিনি অপারেশনে অংশ নিয়েছে, তারা সাধারণত এসেছে জেনিন থেকে। ইসরায়েল যদি মনে করে, ফিলিস্তিনে তাদের সহিংসতা আত্মরক্ষামূলক– সেটি ভুল। ফিলিস্তিন কিংবা যে কোনো জায়গায় সামরিক দখলকারীরা এমনটি করতে পারে না। আত্মরক্ষা কেবল স্বাধীন-সার্বভৌম জাতির জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তাদের সীমান্তের মধ্যে যে কোনো হুমকি মোকাবিলায় আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও আইনের সংজ্ঞা অনুসারে, ফিলিস্তিনে ইসরায়েল কেবল ‘জোরপূর্বক দখলকারীই’ নয়; জাতিসংঘ মহাসচিবের ২০ জুনের বক্তব্য অনুযায়ী, সব বেসামরিক নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। এর আগের দিন জেনিনে আট ফিলিস্তিনি হত্যার পর জাতিসংঘ মহাসচিব সেই বিবৃতি দেন। ওই সময়ে প্রাণ হারানো আট ফিলিস্তিনির মধ্যে দুটি শিশু ছিল– ১৪ বছর বয়সী সাদিল ঘাষান তুর্কম্যান এবং ১৫ বছরের আহমেদ সাকর। এটা বলা নিষ্প্রয়োজন, এসব শিশু এবং ফিলিস্তিনি অন্যান্য শিশুর সুরক্ষায় ইসরায়েল কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি বিবৃতি দিয়েই সন্তুষ্ট থাকছে। তারা ওই ঘটনায় ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করে ইসরায়েলকে তার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। ওয়াশিংটনের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, তারা এমনকি ফিলিস্তিনিদের দোষ দিতেও ভোলেনি। তারা বলতে চাইছে, প্রতিরোধ ছাড়া ফিলিস্তিনিরা অন্য কিছু করতে পারত।
লায়ন’স ডেন, জেনিন ব্রিগেডস, নাবলাস ব্রিগেডসসহ অন্যান্য গ্রুপ ও ব্রিগেডের উত্থান ঘটেছে প্রধানত দরিদ্র ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের হাতে। দুর্বল অস্ত্রই তাদের সম্বল। তাদের এ ছাড়া আর কোনো রহস্য নেই। কেউ যখন অত্যাচার, অসম্মান, নিপীড়ন ও নিয়মিত ভিত্তিতে সহিংসতার শিকার হয়, তখন তার যুদ্ধ করা ছাড়া কোনো পথ থাকে না। পৃথিবীর শুরু থেকে এভাবেই মানুষের সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি। তবে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ তাদের জন্য পীড়াদায়ক, যারা স্থিতিশীলতার কথা বলছে। এর মধ্যে অন্যতম ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ।
ফিলিস্তিনিদের বিদ্রোহ উত্তর-পশ্চিম তীরের সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত হলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ অনেক কিছু হারাতে পারে। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের যে সীমানায় কর্তৃত্ব রয়েছে সেটাও তিনি হারাতে পারেন। যদিও এসব পদ ছাড়া কৃত্রিম বিদেশি তহবিল দ্রুত কমে আসবে এবং দলের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
ইসরায়েলের জন্য ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ শঙ্কার কারণ। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী রয়েছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর শত্রু প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গালান্ট এর নেতৃত্বে। যিনি ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়াতে চান, কিন্তু ২০০২ সালের মতো পূর্ণ শক্তি দিয়ে শহর দখলের পুনরাবৃত্তির পক্ষে নন। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেট চায় পূর্ণোদ্যমে হামলা।
তা ছাড়া রাজনৈতিক ও আইনগতভাবে সংকটে রয়েছেন নেতানিয়াহু। তিনি চাইছেন, প্রত্যেকের প্রত্যাশার চাইতে কম দিতে, কিন্তু সব একবারে দিতে। এর ফলে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। ইন্তিফাদার পর এটাই ফিলিস্তিনিদের প্রথম সুযোগ দিচ্ছে। উল্লেখ্য, শিন বেট তার তালিকা আরও বড় করছে। ফলে আরও গুপ্তহত্যা আমরা দেখব।
একই সঙ্গে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ইতোমধ্যে অবৈধ বসতি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ইসরায়েলে জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির শান্তিপূর্ণ ফিলিস্তিনি গ্রামে গণহত্যা চালানোর জন্য বসতি স্থাপনকারীদের ব্যবহার করতে চাইছেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি হুয়ারায় যে আগুন জ্বলেছিল, তার পুনরাবৃত্তি ২১ জুন দেখা গেছে তুরমুসাইয়ায়।
যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ধুয়া তুলে এ ব্যাপারে চুপ থাকছে। ফিলিস্তিনে কী হচ্ছে তা তাদের সতর্কভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। এটা অভ্যন্তরীণ বলে চালানো যায় না, বা এটি সাধারণ কোনো বিষয় নয়।
পরবর্তী ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা বা প্রতিরোধ হবে সশস্ত্র ও সম্মিলিত, যার পরিণতি খুব খারাপ হতে পারে। যদিও ফিলিস্তিনিদের জন্য উত্থান হলো সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক ধরনের কান্না। স্মোট্রিচ ও বেন গভিররা আরও বেশি বর্বরতা, জাতি হত্যা ও গৃহযুদ্ধ লাগানোর কৌশল নিয়েছেন। হুয়ারা ও তুরমুসাইয়ার ঘটনা বিবেচনায় নিলে মনে হবে, গৃহযুদ্ধ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।